এসপি এডিসি ওসিসহ গভর্নিং বডির দায়িত্বে গাফিলতি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় এসপি, এডিসি, ওসি, মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহসভাপতিসহ স্থানীয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে পুলিশি তদন্ত কমিটি।

মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টায় অ্যাডিশনাল ডিআইজি (ডিসিপ্লিন) রেজাউল করিমের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন কমিটির প্রধান ডিআইজি এসএম রুহুল আমিন। এ সময় কমিটির অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার পর পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসনের গাফিলতি খতিয়ে দেখতে পুলিশ সদর দফতরের এ তদন্ত কমিটি গঠন করে।

পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, সোনাগাজীর সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সভাপতি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) পিকেএম এনামূল করিম, সহসভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন, স্থানীয় পৌর কাউন্সিল মাকসুদ আলমসহ স্থানীয় জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেননি।

এ বিষয়টি তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পুলিশ প্রশাসনের যাদের বিরুদ্ধে গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগী ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

এদিকে সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে আরও এক মাস সময় পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই।

মঙ্গলবার প্রতিবেদনটি দাখিল করার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু ফরেনসিক রিপোর্ট না পাওয়ায় পিবিআই প্রতিবেদন দাখিল না করে সোমবার আরও ৩০ দিনের সময় চেয়ে আদালতে আবেদন করে।

মঙ্গলবার আবেদন মঞ্জুর করে বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী দিন ২৭ মে ধার্য করেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নজরুল ইসলাম শামীম যুগান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এছাড়া রাফি হত্যা মামলার অন্যতম আসামি শাহাদাৎ হোসেন শামীমকে ৩ দিনের রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার আদালতে হাজির করে আরও ৫ দিনের রিমান্ড চান তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর পরিদর্শক শাহ আলম। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন বৃহস্পতিবার শুনানির দিন ধার্য করলে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

এর আগে সোমবার রাফির মামলায় মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীসহ অন্তত ৩০ জনের লিখিত ও মৌখিক সাক্ষ্য গ্রহণ করে পিবিআইর তদন্ত দল।

এদিন তদন্ত দলের কাছে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার নাইটগার্ড মোস্তফা সাক্ষ্য দেয়ার সময় রাফির গায়ের আগুন নেভানোর বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মোস্তফা বলেন, ৬ এপ্রিল পরীক্ষা শুরুর ১০-১২ মিনিট আগে হবে। আমি তখন গেটে ডিউটি করছি। আগুন-আগুন বাঁচাও বাঁচাও আর্তচিৎকার শুনে মাদ্রাসার শেল্টার সেন্টারের দিকে দৌড় দিই।

দেখি সিঁড়ি দিয়ে রাফি নেমে আসছে। তার সারা গায়ে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। বিন্দুমাত্র কাপড় নেই শরীরে। মাংসগুলো আগুনে সিদ্ধ হয়ে খসে পড়ছে মাটিতে। তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিজের মেয়ের ছবি। আমি রীতিমতো হতভম্ব হয়ে পড়ি। হাতের কাছে যা পেয়েছি, তা দিয়েই আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছি। পেছন থেকে একজন পাপোশ ছুড়ে দেন।

সেই পাপোশ দিয়ে আমি রাফির গায়ের আগুন নেভানোর চেষ্টা চালাই। তিনি বলেন, রাফি বাঁচার আকুতি জানিয়ে চিৎকার করছিল, তার গলা দিয়ে অস্পষ্ট শব্দ বের হচ্ছিল। সেদিনের ওই দৃশ্য যখন আমার চোখে ভাসে, তখন আমি কান্না থামাতে পারি না।

কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে এ দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। বিশ্বাস করেন, রাতে ঘুমাতে আমি এখনও ভয় পাই। আমি আবার হার্টের রোগী। চিকিৎসক বলেছেন, কোন ধরনের টেনশন না করতে। কিন্তু ঘুরেফিরে রাফির গায়ে আগুন আমার চোখের সামনে ভাসে।

প্রসঙ্গত, ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। কয়েকজন তাকে কৌশলে ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। অস্বীকৃতি জানালে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।

এ ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা, পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।

১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান অগ্নিদগ্ধ রাফি। এর আগে ২৭ মার্চ ওই ছাত্রীকে নিজ কক্ষে নিয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

পরে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রোববার তাদের আদালতে হাজির করা হয়। এ পর্যন্ত রাফি হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার ২২ জনের মধ্যে সিরাজ উদ্দৌলাসহ ৯ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

রোডমার্চ-মানববন্ধন : ফেনী ও সোনাগাজী প্রতিনিধি জানান, রাফি হত্যার বিচারের দাবি ও অপর জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে মঙ্গলবারও বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়েছে। এদিন দুপুরে ঢাকা থেকে রোডমার্চ করে এসে যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোটের সদস্যরা সোনাগাজী জিরোপয়েন্টে পৌঁছে মানববন্ধন ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন।