এবার গবেষণায় জালিয়াতির অভিযোগ ঢাবি শিক্ষক লীনা তাপসীর বিরুদ্ধে

এবার পিএইচডি গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি করার অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সঙ্গীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মহসীনা আক্তার খানমের (লীনা তাপসী খান) বিরুদ্ধে। ১৫টি অধ্যায় সম্বলিত ২৭৭ পৃষ্ঠার ‘নজরুল সঙ্গীতে রাগের ব্যবহার’ নামে তার একটি গবেষণা প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। পরে ২০১১ সালে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। বইয়ের মোট ১৫টি অধ্যায় রয়েছে। এর মধ্যে ১১টির ১৫২টি পৃষ্ঠায় কোনো ধরনের রেফারেন্স ছাড়াই বিভিন্ন লেখক ও গ্রন্থের অংশ তুলে ধরা হয়েছে।

বিভাগীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের মে মাসে তিনি এটি পিএইচডি থিসিস হিসেবে উপস্থাপন করেন। ২০১৬ সালে লীনা তাপসী খান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। ২০১১ সালে নজরুল একাডেমি তার ওই থিসিস বই আকারে প্রকাশ করলে এতে বিভিন্ন অংশ নকল করার বিষয়টি সামনে আসে।

 এটি একটি বড় রকমের চুরি। আমি একটি অভিযোগপত্র পেয়েছি। এই মুহূর্তে কী কী করা যায় বা যায় না, তা আমি বলতে পারব না। এসব কাজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ক্ষুণ্ণ করে। আগামী সিন্ডিকেট মিটিংয়ে এ বিষয়টি ওঠার কথা রয়েছে। উঠলে আমরা কথা বলব। আর এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তি পেতে হবে 

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্ট ছয়টি দফতরে এ সংক্রান্ত অভিযোগ দিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ইফফাত আরা নার্গিস।

অভিযোগে বলা হয়েছে, লীনা তাপসী খান ‘নজরুল সঙ্গীতে রাগের ব্যবহার’ গ্রন্থে ২৭৭ পৃষ্ঠার মধ্যে প্রায় ১৫২ পৃষ্ঠার লেখাই বিভিন্ন বই থেকে হুবহু নকল করে নিজের বলে চালিয়ে দেন। অবশিষ্ট পৃষ্ঠাগুলোর অনেক তথ্যও সঠিক নয়।

অভিযোগ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘নজরুলের গানের শ্রেণিবিন্যাস’। এই অধ্যায়ের ব্যাপ্তি সাড়ে চার পৃষ্ঠা। কাজী নজরুল ইসলামের গানের নাম নিয়ে অধ্যায়টির শিরোনাম হলেও এর আড়াই পৃষ্ঠাই রবীন্দ্রনাথের গানের শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে। বাকি দুই পৃষ্ঠা নজরুলের গানের শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে লেখা। এই অধ্যায়ের লেখাগুলো নেয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’ ও ‘নজরুল-গীতিকা’ থেকে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘জয় নারায়ণ অনন্ত রূপধারী’ গানটি উল্লেখ করে রাগটি নজরুল-সৃষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন এভাবে- ‘জয় নারায়ণ অনন্ত রূপধারী এ গানটিও নজরুল-সৃষ্ট নিশাশাখ রাগে সৃষ্ট’ (পৃষ্ঠা ১১)। অথচ, বিষ্ণুপুর ঘরানার বিশেষ প্রচলিত এ রাগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও গান রচনা করেছেন (‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা’)। নজরুল রচিত গানটি নিশাশাখ রাগের হলেও রাগটি নজরুল-সৃষ্ট নয়।

তৃতীয় অধ্যায়ে ‘নজরুলের মূল গান ও ভাঙা গান’ শিরোনামে একটি তালিকা দিয়েছেন লীনা তাপসী। এ তালিকার ২ নম্বর ক্রমিকে নজরুলের ভাঙা গান হিসেবে উল্লেখ করেছেন ‘এ কি তন্দ্রা বিজড়িত আঁখি’ গানটি। প্রকৃতপক্ষে গানটি নজরুল রচিত নয়। এর রচয়িতা হলেন তুলসী লাহিড়ী।

চতুর্থ অধ্যায়ে ‘ঠুমরী অঙ্গের গানে রাগের ব্যবহার’ শিরোনামে লেখাটি তথ্য-নির্দেশ ছাড়াই হুবহু ‘ইদ্রিস আলী, নজরুল-সঙ্গীতের সুর’, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, ১৯৯৭’ থেকে নেয়া হয়েছে।

পঞ্চম অধ্যায়েও ‘গজলে রাগের ব্যবহার’ লেখাটি রেফারেন্স ছাড়াই হুবহু ‘ইদ্রিস আলী, নজরুল-সঙ্গীতের সুর’, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, ১৯৯৭’ থেকে নেয়া হয়েছে।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে ‘টপ্পা গানে রাগের ব্যবহার’ লেখায় ‘প্রাচীন বেসরা গীতি থেকেই হয়েছে টপ্পার জন্ম’ লাইনটি নেয়া হয়েছে হুবহু ‘ইদ্রিস আলী, নজরুল-সঙ্গীতের সুর’, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, ১৯৯৭’ থেকে।

jagonews24

‘কাজরী, ভজন ও শ্যামা সঙ্গীতে রাগের ব্যবহার’ শীর্ষক সপ্তম অধ্যায়ে গবেষক লিখেছেন, ‘থির হয়ে তুই ব’স দেখি মা’ গানটি তার নিজের (লীনা তাপসী খান) সুর করা। গানটির শুরুর অংশে রাগ আশাবরীর ব্যবহার হয়ে রাগ বিলাবলের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে এ গানটি বাংলা কীর্তন গানে প্রচলিত মনোহরশাহী ঢঙের সুরে রচিত। এ গানের রাগ নির্দেশ করতে চাইলে একে বিষ্ণুপুর ঘরানায় প্রচলিত মিশ্র বিভাষ বলা যেতে পারে।

দশম অধ্যায়ের ‘নজরুল রচিত লক্ষ্মণ গীত’ লেখায় সাত পৃষ্ঠা নেয়া হয়েছে ‘ইদ্রিস আলী, নজরুল-সঙ্গীতের সুর’, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, ১৯৯৭’ থেকে কোনো তথ্য-নির্দেশ ছাড়াই।

একাদশ অধ্যায়ে এখানে ‘নজরুল-সঙ্গীতে দক্ষিণী রাগের ব্যবহার’-এ প্রায় ৫ পৃষ্ঠা নেয়া হয়েছে একই জায়গা থেকে।

লীনা তাপসী ত্রয়োদশ অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন ‘নজরুল-সৃষ্ট কতিপয় রাগ ও বন্দিশ’। এ অধ্যায়ে স্বরলিপিসহ উল্লিখিত বন্দিশগুলোর রচয়িতা পশ্চিমবঙ্গের নজরুল গবেষক শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, নজরুল নন। ‘নজরুল সৃষ্ট রাগ ও বন্দিশ’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে কোনো ধরনের গ্রন্থ-ঋণ স্বীকার না করেই হুবহু নকল করে ছাপানো হয়েছে এ অংশ।

লীনা তাপসী খান তার গ্রন্থের ‘নজরুল রচিত ভাঙা খেয়াল ও ফৈয়াজ খাঁর মূল বন্দিশ’ শীর্ষক চতুর্দশ অধ্যায়েও একই ধরনের চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিয়েছেন। এ অধ্যায়ের ১৯৭ থেকে ২৪৪ পর্যন্ত ৪৮ পৃষ্ঠা কাকলী সেন প্রণীত ‘ফৈয়াজী আলোকে নজরুল-সংগীত’ শীর্ষক বই থেকে হুবহু নকল করা। এখানে রেফারেন্স ছাড়াই ১৭টি গানের সারণি হুবহু স্ক্যান করা হয়েছে। হুবহু নকল করতে গিয়ে ১১ থেকে ১৫ পর্যন্ত গানের তথ্য দুইবার দেয়া হয়েছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ২৮০ পৃষ্ঠার গ্রন্থে ৮০ পৃষ্ঠার স্বরলিপি হুবহু নকল করে ঢোকানো হয়েছে মূল পাঠ হিসেবে। যা অনৈতিক। এই ৮০ পৃষ্ঠার স্বরলিপির স্থান হতে পারত গ্রন্থের পরিশিষ্টে। মূল পাঠে এই স্বরলিপি কোনোক্রমেই স্থান পাওয়ার কথা নয়। এটিও এক ধরনের চৌর্যবৃত্তি। ২৭৭ পৃষ্ঠার বইয়ের মধ্যে ৮০ পৃষ্ঠা স্বরলিপি, ২৬ পৃষ্ঠা শ্যামপ্রসাদ মুখোপধ্যায়ের গ্রন্থ, ৪৬ পৃষ্ঠা কাকলী সেনের গ্রন্থ এবং ১৭ পৃষ্ঠা পরিশিষ্ট। যা লীনা তাপসী খানের রচনা নয়। এগুলো অন্যের গ্রন্থ থেকে হুবহু নেয়া। বাকি ১০১ পৃষ্ঠার মধ্যে ইদ্রিস আলীর নজরুল ইনস্টিটিউট ঢাকা থেকে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ‘নজরুল সঙ্গীতের সুর’ নামক গ্রন্থ থেকেও নেয়া হয়েছে। কিন্তু লীনা তাপসী খান তা অস্বীকার করেন।

এ অভিযোগের বিষয়ে নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ইফফাত আরা নার্গিস  বলেন, ‘গ্রন্থটির সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হলো এতে রাগ-সুর নির্দেশিত নজরুল সঙ্গীতের কোনো তালিকাই নেই। অথচ গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে ‘নজরুল-সঙ্গীতে রাগের ব্যবহার’।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কখনোই পিএইচডি গবেষণা জালিয়াতি করে শিক্ষকতার সুযোগ পেতে পারেন না। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যায় না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ ছয় জায়গায় এই অভিযোগপত্র দাখিল করেছি। আমি আশা রাখছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মহসীনা আক্তার খানম ওরফে লীনা তাপসী খান  বলেন, ‘এই বই আমার। এটিতে কোনো ঝামেলা থাকলে সেটা বিশ্ববিদ্যালয় দেখবে। আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ  বলেন, ‘এটি একটি বড় রকমের চুরি। আমি একটি অভিযোগপত্র পেয়েছি। এই মুহূর্তে কী কী করা যায় বা যায় না, তা আমি বলতে পারব না। এসব কাজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ক্ষুণ্ণ করে। আগামী সিন্ডিকেট মিটিংয়ে এ বিষয়টি ওঠার কথা রয়েছে। উঠলে আমরা কথা বলব। আর এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তি পেতে হবে।’

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এরকম একটি অভিযোগ আমি পেয়েছি। এখনো পড়ার সময় হয়নি। আমি পড়ে দেখবো। আর এসব বিষয়ে আমরা খুব কঠোর। অপরাধী যেই হোক না কেন কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’

 

সুত্রঃ জাগো নিউজ