এতো বিতর্ক সত্ত্বেও কেন মামুনুলকেই সমর্থন হেফাজতের

হেফাজত ইসলামের শীর্ষ নেতাদের এক সভায় নিরঙ্কুশ সমর্থন জানানো হয়েছে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের এক রিসোর্টে নারীসহ অবস্থানের ঘটনা নিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসা মামুনুল হকের প্রতি এবং এর কারণ হিসেবে সংগঠনটির নেতারা বলছেন, মি. হকের বিরুদ্ধে বিতর্কটি তৈরি করেছে সরকার নিজে।

মি. হক দাবি করেছেন, যাকে নিয়ে তিনি ওই রিসোর্টে গিয়েছিলেন তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রী, যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে ওই নারী মি. হকের স্ত্রী নন। এ নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্কের মধ্যেই হেফাজতের বৈঠক থেকে মি. হকের প্রতি সমর্থন এলো।

এর আগেও মামুনুল হকের বক্তব্যের পর সেই বক্তব্যকে উস্কানিমূলক বলে এক ব্যক্তির ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার জের ধরে সুনামগঞ্জে হিন্দু গ্রামে হামলার ঘটনা ঘটেছিলো।

মূলত, ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য-বিরোধী বক্তৃতা দিয়ে আলোচনায় আসার পর থেকে গত কয়েকমাস ধরেই তাকে নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে।

একের পর এক বিতর্ক তৈরির পরেও কেন মি. হকের পক্ষেই অবস্থান নিচ্ছে হেফাজত এমন প্রশ্নের জবাবে সংগঠনটির নায়েবে আমির আব্দুর রব ইউসুফী বলছেন, “সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা মামুনুল হককে বিতর্কিত করতে কাজ করছে। আর সরকার কারও বিরুদ্ধে লেগে গেলে দোষ তো ধরাই যায়। মন্ত্রী মিনিস্টারদের নামেও তো কত কিছু শোনা যায়। তাই এগুলো আমরা ধর্তব্যের মধ্যে নিতে রাজী নই।”

আর মি. হকের পক্ষে হেফাজত নেতাদের এমন নিরঙ্কুশ সমর্থনের জন্য তার ব্যাপক জনপ্রিয়তার দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী।

তিনি বলেন, “মামুনুল মানেই হেফাজত এবং তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ও জোরালো বক্তব্য মানুষকে উৎসাহিত করছে। সরকার তাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে”।

হেফাজত ইসলাম মুলত কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন

যদিও হেফাজত ইসলামের মধ্যেই মামুনুল হককে নিয়ে অস্বস্তিও আছে বলে কয়েকজন নেতা ধারণা দিয়েছেন।

তবে তারা এখনি মি. হকের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অবস্থান নিতে রাজী নন মূলত হেফাজত ইসলামকে ঐক্যবদ্ধ রাখা আর সমর্থকদের মধ্যে মামুনুল হকের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কথা চিন্তা করে।

তাদের কেউ অবশ্য এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।

আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলছেন, “আমরা তো তার ত্রুটি দেখছিনা। একটি কুচক্রিমহল যারা ক্ষমতাবলে দেশকে আঁকড়ে রাখতে চায় তারা এসব ষড়যন্ত্র করছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচার জুলুম ও ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে মামুনুল হক শক্তিশালী বলেই তাকে নিয়েই আমরা এগুবো।”

যদিও হেফাজত নেতারা এভাবে আনুষ্ঠানিক মন্তব্যে মি. হকের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিচ্ছেন তবে সংগঠনটির মধ্যে অনেকেই প্রয়াত আহমদ শফির সময়কাল থেকেই তার ভূমিকার জন্য মি. হকের প্রতি ক্ষুব্ধ।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় আসেন মামুনুল হক। সফরের দিনে হেফাজতে ইসলামের সমর্থকদের বিক্ষোভ।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় আসেন মামুনুল হক। সফরের দিনে হেফাজতে ইসলামের সমর্থকদের বিক্ষোভ।

আবার সংগঠনের যে সমন্বিত নেতৃত্ব কাঠামো তৈরি হয়েছিলো সেটি ভেঙ্গে মামুনুল হকসহ কয়েকজনকে ঘিরে যে বলয় তৈরি হয়েছে তারও পক্ষে নন অনেকে।

সবশেষে সোনারগাঁওয়ের ঘটনার পর যেহেতু সরকার সুনির্দিষ্ট অবস্থান নিয়েছে মি. হকের বিরুদ্ধে সেকারণে সংগঠনকে রক্ষায় আপাতত তার বিরুদ্ধে যেতে রাজী নন কেউই।

হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব নাসির উদ্দিন মুনির বলছেন, “সরকারও তাকে হেনস্থা করছে, এখন আমরাও যদি তার বিপক্ষে যাই-সেটি তো যৌক্তিক হয়না। আমরা বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান করে দেখেছি যে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ আনা হয়েছে।”

তিনি বলেন, মামুনুল হক এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে আর সে কারণেই তাকে হেনস্থা করতে তার ব্যক্তিত্বের ওপর আঘাতের ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

আহমদ শফীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলামের উত্থান হয়েছিলো

তবে সংগঠনটির নেতাদের কয়েকজন ধারণা দিয়েছেন যে শীর্ষ বা আলোচিত নেতাদের কাউকে নিয়ে এমন বিতর্ক আগে হয়নি আবার কেউ এমন ভাবে বিতর্কে জড়াবেন সেটি তারা কখনো বিবেচনাতেই আনেননি।

আবার হেফাজত নেতা আহমদ শফির মৃত্যুর পর এর নেতৃত্ব নিয়ে যে বিবাদ তা কাটিয়ে সংগঠনটিকে এক রাখার স্বার্থে এখন আর মামুনুল হক ইস্যুতে খুব বেশি এগুতে আগ্রহী নন অনেকে।

অন্যদিকে মামুনুল হক ইস্যুতে সরকার সামনে কোন দিকে যায় সেদিকেও দৃষ্টি আছে অনেক নেতার, যদিও দলের মধ্যে মামুনুল হক বিরোধী অবস্থান নিয়ে নতুন করে কোন আলোচনায় আসতে কেউই উৎসাহী নন।

সংগঠনটির আরেকজন নেতা ও এর কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ সম্পাদক মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী অবশ্য বলছেন, মি. হককে নিয়ে কোন ভিন্নমত নেই সংগঠনের মধ্যে।

তিনি বলেন, “একটা উচ্চতায় পৌঁছালে বিতর্ক হওয়াই স্বাভাবিক। তবে কখনো যদি মনে হয় উনাকে নিয়ে চলা সম্ভব হবেনা তখন আমরা সেটি চিন্তা করবো। কিন্তু এখনো সে সময় আসেনি।”

মি. হোসাইন বলেন সর্বশেষ ঘটনায় মামুনুল হকের বিরুদ্ধে দোষ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

“সত্যিকার অর্থে উনাকে নিয়ে চলা সম্ভব না হলে তখন সেটি বিবেচনা করা হবে। কিন্তু এখন সে প্রশ্ন আসেনা। যতদিন সম্ভব আমরা উনাকে সামনে নিয়েই আগাবো” ।

প্রয়াত আহমদ শফীর সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন শেখ হাসিনা

হেফাজতের সভায় যা বলা হয়েছে

বাংলাদেশের ঢাকাস্থ কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের জরুরি বৈঠক জামিয়া রাহমানিয়ায় সোমবার অনুষ্ঠিত হয় যাতে সভাপতিত্ব করেন নায়েবে আমীর মাওলানা আব্দুল হামিদ।

সভার পর গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “মাওলানা মামুনুল হক গত ৩রা এপ্রিল তার স্ত্রীকে নিয়ে সোনারগাঁও রির্সোটে গিয়ে ছিলেন। ইসলামী শরিয়তের আলোকে তার বিবাহ পরিপূর্ণ শুদ্ধ মর্মে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এ নিয়ে বিভ্রাতির কোনো অবকাশ নেই”।

এতে আরও বলা হয় যে দেশের যে কোনো নাগরিক তার স্ত্রী-পরিবার নিয়ে যে কোনো স্থানে যাওয়ার অধিকার রাখে।

“কিন্তু মাওলানা মামুনুল হকের মত পরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তির উপর সন্ত্রাসীরা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আমরা তার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি এবং অভিযুক্তদেরকে বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি। জাতীয় সংসদে একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত বিষয়কে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, এটা জনগণ কখনোই আশা করেনি।”

সূত্র:বিবিসি