এতিম-নিঃস্ব বই বিক্রেতা ছোট্ট তাহসান হতে চায় সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য!

সামাউন বশির শামস: 

নাম,পরিচয়হীন এক ছোট্ট কিশোর। যার পেট চলে ট্রেনের বগিতে ঘুরে ঘুরে বই বিক্রির মাধ্যমে। নেই বাবা-মায়ের কোনো খোঁজ। আর তার নেই কোনো পরিবার। ১০ বছর বয়সী ছোট্ট এই কিশোর বই বিক্রি করে জমানো টাকা দিয়ে দিবেন জুসের দোকান। সেই ব্যবসার টাকা জমিয়ে পড়ালেখা করে হতে চায় সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সদস্য। সম্প্রতি (গত ২৪ জুলাই) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ডিনস কমপ্লেক্স ভবনের সামনে ফেরারী এই বই বিক্রেতা বালকের সঙ্গে প্রতিবেদকের হঠাৎ দেখা হয়। বালকটির দূরন্তপনা দেখে প্রতিবেদকের চোখ আটকে যায় তার দিকে। যেন অজানা কোনো সম্ভাবনা তাকে হাতছানি দিচ্ছে। এমন অন্যরকম এক বালক দেখেই তার সঙ্গে প্রতিবেদকের কথপোকথনের আগ্রহ তৈরী হলো। 

বাসা কোথায় জানতে চাইলেই মুসকি এক হাসি দিয়ে প্রতিবেদকের সঙ্গে শুরু করলেন আলাপ। তারপরই মলিন চেহারায় তার এতিম আর নিঃস্ব হওয়া ১০ বছরের জীবনের এবং ভবিষ্যতে কী হতে চান তা জানালেন।

কথা বলে জানা গেল- ছোট থেকেই লালন-পালন করে আসা এক বৃদ্ধ যাকে দাদা বলেই মানতো এই কিশোর। সেই দাদাও মারা গেছে বছর চারেক আগেই। ট্রেনে যাত্রায় হঠাৎ একদিন পরিচয় হয় অপরিচিত এক ব্যক্তির সাথে।  তার সাথে পরিচয়ও এই বই বিক্রির মাধ্যমে। এক পর্যায়ে আদর করে পিতা-মাতাহীন এই ছোট্ট কিশোরের নামও রেখে দিলেন অপরিচিত ব্যক্তি। বালকটির নাম রাখলেন তিনি  জুবায়ের হোসেন তাহসান। বর্তমানে এই নামেই বালকটি নিজেকে পরিচয় দেয় সবার কাছে।

ছোট্ট তাহসান যেই বয়সে খাতা-কলমের সাথে বই নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা। সেই বালক নিজে স্কুলে না পড়ে জীবিকার তাগিতে ট্রেনের বাগিতে ছুটছে বই নিয়ে ।  করোনাকালেও থেমে ছিল না তার এই একাকি জীবন চালানোর এই যুদ্ধ। সে সময় মাস্ক বিক্রয়ের মাধ্যমে উপার্জন করতো বলে জানায় এই ছোট্ট কিশোর।

কোথায় থাকো এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলে- কয়েক মাস আগে জয়পুরহাট এলাকায় পাড়ি জমায় সে। সেখানে এলাকার এক মেম্বার তাকে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় মাসিক ৫০০ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে।  কিছুদিন আগেও থাকার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা ছিল না তার। স্টেশনেই রাত পার করতো ছোট্ট তাহসান। উপার্জন কম হওয়ায় ভাড়ায় কোথায় থাকার যে তার সম্বল ছিল না। এতো কষ্ট করেও ভিক্ষাবৃত্তিতে পা বাড়ায়নি কখনো।

কেননা- পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জনে বিশ্বাসী এই কিশোর। বর্তমানে বই বিক্রি করে দিনে ২০০-৩০০ টাকা উপার্জন করে। তা দিয়েই চলে তার ছোট্ট জীবন। পাশাপাশি কিছু কিছু করে জমাও করে। কেননা তার স্বপ্ন ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে দেশকে রক্ষার মহান দায়িত্ব নেয়ার। তার এই অদ্ভুত স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলে ছোট্ট এই বালক তার ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা জানান। বলেন, ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য পড়াশোনা করবে। আর সেজন্যই  টাকা জমিয়ে জয়পুরহাটে শুরু করবে ব্যবসা।সেখানে ছোট একটি দোকান দিবে জুসের এবং পরিচয় লাভ করবে ছোট ব্যবসায়ী হিসেবে।

ইতোমধ্যেই দোকান দেয়ার জন্য ৫০০০ টাকাও জমিয়েছে তাহসান। সেই সাথে এরই মধ্যে চেয়ার, টেবিল এবং যাবতীয় সরঞ্জামও কিনে ফেলেছে । তবে এখনও ৩৫০০ টাকা জমানো বাকি এই স্বপ্ন পূরণ করতে। এভাবেই নিজের ভবিষ্যত সেনাবাহিনী হওয়ার স্বপ্নের গল্প করছিলো সে। প্রতিদিন জয়পুরহাট থেকে বাংলাবান্ধা ট্রেনে বই কাধে নিয়ে রাজশাহীতে আসে। তবে তার নেশা সুযোগ পেলেই ঢুকে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সাজ্জাদের ভাজার দোকানে লেবুচুর খেতে। সাথে ব্যবসাও হয়ে যায়। সাজ্জাদের ভাজার দোকানে লেবুচুর খেতে এসে তার সঙ্গে অনেকটা বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্ক গড়ে কিশোর তাহসানের। সাজ্জাদকে সে ডাকে মামা বলে। 

তুমি ছোট্ট মানুষ, একা একা এভাবে ট্রেনে যাতায়াত করতে ভয় লাগে না এমন প্রশ্ন করতে না করতেই তাহসান বলে উঠে, ‘ভয় কিসের! আল্লাহ আছে না? কপালে খারাপ কিছু লেখা থাকলে হবে, পরকালে আল্লাহ তার হিসাব নেবে।’  ছোট্ট এই প্রতিভাবান বালকটি সম্পর্কে ক্যাম্পাসের ভাজা ব্যবসায়ী সাজ্জাদের নিকট জানতে চাইলে তিনি জানান, ছেলেটা খুবই অমায়িক, এত সহজ সরল ছেলে তিনি কখনও দেখেননি। ছেলেটা কখনও চেয়ে খায় না, খাবারের যেটা দাম সেটা সে দিয়েই লেবুচুর খেয়ে যায়।

অদ্ভুত এক চিন্তার কথা শুনে যেন প্রতিবেদকের যেন হয়ে যায়। কথার এক ফাঁকে হঠাৎই কিশোর গ্যাং নিয়ে কথা বলে ফেললো। মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমেই কিশোর গ্যাং তৈরী হয়। এজন্য সে নিজে অল্প বয়সে মোবাইল ব্যবহার করবে না বলে জানায়। তার মতে, মোবাইল ব্যবহার করলে সে তার কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে না। আর এজন্য সে প্রতিষ্ঠিত হবে তারপর ব্যবহার শিখবে মোবাইলের।

তাহসান হারিয়েছে বাবা-মা। হারিয়েছে সবকিছু। কিন্তু যেন ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুননকে সঙ্গী করে নিয়ে ঘুরছে পথে-ঘাটে। আর এভাবেই সকল বাধা-বিপত্তি ভেদ করে বাস্তবায়ন করতে চায় তার স্বপ্ন, এগিয়ে যেতে চায় সামনের দিকে। বই বিক্রেতা নয়; জীবনে একদিন সে সেনাবাহিনীর গর্বিত একজন সদস্য হিসেবে পরিচয় দেয়ার স্বপ্ন যেন তাকে প্রতিনিয়ত ব্যাকুল করে তুলছে। হয়তো রুটির দোকানে কাজ করে কাজী নজুরুল ইসলাম হয়ে উঠেছিলেন একজন বিদ্রোহী কবি। আর ছোট্ট তাহসান এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ট্রেনযোগে বই বিক্রি কিংবা ব্যবসার ফাঁকে পড়ালেখা করে সেনাবাহিনীতে চাকরি করে প্রিয় মাতৃভূমিকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে করবে রক্ষা। 

এএইচ/এস