এখন আমাদের রপ্তানিকারক দেশের পরিচিতি পাওয়া দরকার

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

সদ্যঃসমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন (পাঁচ হাজার কোটি) মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। এটি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি যুগান্তকারী অর্জন। এই মুহূর্তে প্রয়োজন হলো রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা। কারণ রপ্তানি স্থবির হয়ে পড়ার উদাহরণ বিশ্বে অনেক আছে।

তাই আমরা বেশি কিছু অর্জন করে ফেলেছি এই ভাবনা যেন আমাদের পেয়ে না বসে। বরং আমরা পেছনে কেন ছিলাম, সেটা মনে রেখে সামনে এগোনো উচিত। থাইল্যান্ডের দিকে তাকালে দেখতে পাব, দেশটি শুধু পর্যটন থেকে যে রাজস্ব পাচ্ছে তা আমাদের মোট রপ্তানির কাছাকাছি। ভারত শুধু জুয়েলারি রপ্তানি করে ৫০ বিলিয়ন ডলারের। এ ছাড়া জিডিপির আকারে আমাদের সমপর্যায়ের অর্থনীতি রয়েছে—এমন অনেক দেশের রপ্তানি আমাদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।

ভিয়েতনামের কথা ধরা যাক। দেশটি আমাদের পেছন থেকে শুরু করেছে; কিন্তু এগিয়ে গেছে অনেক দূর। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে তৈরি পোশাক উৎপাদনের খরচ বাড়ছে। এটি আমাদের জন্য একটি সুবিধা। আমাদের এখানে শ্রমের মূল্য কম বলে উৎপাদন খরচ কম। তাই বায়াররা আমাদের প্রতি আগ্রহী। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, আমাদের পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধির পেছনে এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। এমন নয় যে আমরা সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন, উচ্চ মূল্যের ডিজাইন ও ফ্যাশনসমৃদ্ধ পণ্যে অন্যদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি। প্রকৃত বিষয়টি হচ্ছে আমাদের এখানে শ্রমের মূল্য কম এবং স্বল্প মূল্যের আইটেমগুলোতে আমরা খুব ভালো করে থাকি। আমাদের ক্রেডিট হচ্ছে, আমরা কম মূল্যে ও কম সময়ের মধ্যে অর্ডার সরবরাহ করতে পারি।

যেভাবেই হোক, এক অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য, যা একসময় আমাদের কাছে স্বপ্ন ছিল। ১০ বছর আগে এটা অর্জন করা সম্ভব ছিল, কারণ আমাদের সে সক্ষমতা ছিল। এই মুহূর্তে এটা ৫৫ থেকে ৫৮ বিলিয়নে নিয়ে যাওয়া উচিত এবং এটা সম্ভব। এটা হবে বলে আশা করছি। তাহলে বাংলাদেশের প্রতি সবার একটা নজর পড়বে যে দেশটির রপ্তানি অব্যাহতভাবে বাড়ছে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, স্থবির হয়ে পড়া যাবে না। স্থবির হয়ে গেলেই সমস্যা। পাকিস্তান স্থবির হয়ে গেছে, শ্রীলঙ্কা স্থবির হয়ে গেছে। চোখের সামনে দেশ দুটির পরিণতি দেখছি। তাই স্থবির হয়ে পড়া আশঙ্কার বিষয়।

আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি রপ্তানিকেন্দ্রিক। তাই রপ্তানি স্থবির হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও স্থবির হয়ে যাবে। এখানে আরেকটা কথা বলা দরকার। আমাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি আয়ের আরেকটি হচ্ছে রেমিট্যান্স। সামগ্রিক অর্থে আমাদের দেশে রেমিট্যান্স কম আসছে বলা যাবে না। কাগজে-কলমে কম এলেও অনানুষ্ঠানিক পথে ঠিকই আসছে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিও বজায় রাখতে হবে।

আমাদের এখানে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির বাধাটা কোথায়? বাধাটা হলো সম্ভাবনাময় বাজারগুলোতে প্রবেশাধিকারের অভাব। মাত্র কয়েক দিন আগে এক সেমিনারে একটি জাপানি কম্পানি বলেছে, বাংলাদেশ থেকে কিছু জাপানি কম্পানি চলে যেতে চায়। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে কারো মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নেই। দুঃখজনক হচ্ছে, এফটিএ না থাকা আমাদের অর্থনীতির একটি বড় দুর্বলতা। অনেক আগে ডাব্লিউটিএর অধীনে বাংলাদেশ যে সুবিধাগুলো পেয়েছিল, সেগুলোই আমরা এখন পর্যন্ত ব্যবহার করছি।

গত ১০-১৫ বছরে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ, পাশের দেশ ভারতও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এক ধরনের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে, আসিয়ানের সঙ্গে করেছে। এমনকি ভিয়েতনাম একসময় যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, সেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ করেছে। এর ফলে ভিয়েতনাম অনেক কম শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মার্কেটে প্রবেশ করেছে, যেখানে আমাদের একই পণ্যকে বেশি শুল্ক দিতে হয়। বাংলাদেশ কেন একটি এফটিএও সই করতে পারেনি। কেন এই ব্যর্থতা? এ ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টার অভাব লক্ষ করি। ভিয়েতনাম যেখানে এক ডজনের বেশি এফটিএ স্বাক্ষর করেছে, বিশাল অর্থনৈতিক ব্লক আসিয়ানের সদস্য হয়েছে, সেখানে আমরা কেন পারলাম না? সামনের দিনগুলোতে এত বড় অর্থনৈতিক গোষ্ঠী গড়ে ওঠা কঠিন হবে। সামনের দিনগুলোতে ইকোনমিক ব্লক ছাড়া ব্যবসা করাও কঠিন হয়ে পড়বে।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে শুধু অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর নির্ভর করে ভালো করা যাবে না। অভ্যন্তরীণ মার্কেটের ওপর নির্ভর করতে গেলে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট বা ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ দুর্বল হয়ে যাবে। যত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ উচ্চ রপ্তানিতে থাকতে পারবে, তত দিন পর্যন্ত আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে এবং বিদেশিরা আমাদের ঋণও দেবে। কারণ সবাই ঋণ দেয় পরিশোধ করার ক্ষমতা দেখে। এখন তারা কেন পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কাকে দিতে চাচ্ছে না? জবাব একটাই, ঋণ ফেরত পাওয়ার ভরসা থাকতে হবে। এখন বাংলাদেশের যে সুবিধাজনক অবস্থা, সেটাই ব্যবহার করা হচ্ছে।

আমার পরামর্শ হবে, বাংলাদেশের আসিয়ানের অ্যাসোসিয়েট সদস্য পদ নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। মনে রাখাা দরকার যে বড় কোনো অর্থনৈতিক জোট কিংবা বড় কোনো অর্থনীতির সঙ্গে এফটিএ করতে পারা মানে এর মনস্তাত্ত্বিক মূল্য আছে। তখন দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারী মনে করতে পারবেন যে আমাদের মার্কেট প্রসারিত হচ্ছে, তাই ব্যবসা সম্প্রসারণ করলে সহজেই পণ্য পাঠানো যাবে। ভারতের সঙ্গে আমাদের এক ধরনের মুক্ত বাণিজ্যের ব্যবস্থা আছে। এর পরও দেখা গেছে, তারা অন্যভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যেটাকে নন-ট্যারিফ বেরিয়ার বলে। ভারত আমাদের এখানে অনেক বেশি পণ্য বিক্রি করছে, আমরা কেন তাদের ওখানে বিক্রি করতে পারছি না—এটা আমাদের বিবেচনা করে দেখা দরকার। ভারত আমাদের জন্য অনেক ভালো মার্কেট হতে পারে। চীনও আমাদের জন্য বড় মার্কেট হতে পারে। জাপানের মার্কেটও আমাদের জন্য অনেক বড়। আমাদের দরকার হচ্ছে বাজার দুটির প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। সবচেয়ে ভালো হবে দু-একটি বড় অর্থনৈতিক জোটের সদস্য হতে পারলে।

প্রশ্ন হতে পারে, শুধু মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে কী হবে, যদি রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য তৈরি করা না যায়? এর জবাব হচ্ছে, বাইরের মার্কেটে প্রবেশাধিকার না থাকলে বৃহত্তর বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে না মানুষ। আমার যদি মার্কেট না থাকে, আমি কোথায় আমার পণ্য বিক্রি করব—এই প্রশ্ন পণ্য উৎপাদনের আগেই করতে হয়। এ জন্য আমার দরকার আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যের ব্যবস্থা করা। এখানে যদি কোনো জাপানি গাড়ি উৎপাদক কম্পানি আসতে চায়, তাহলে তাদের ভাবতে হবে যে তারা বিক্রি করবে কোথায়। তাই বৃহত্তর মার্কেটে প্রবেশাধিকার প্রয়োজন। শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওপর নির্ভর করে সহজেই বাইরের কেউ বিনিয়োগ করতে চাইবে না। করলেও সেটা সীমিত হবে।

মোটকথা, রপ্তানির মাধ্যমে গ্লোবাল লিংকেজ তৈরি করতে না পারলে অর্থনীতি প্রত্যাশিত মাত্রায় ভালো করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের পৃথিবীকে জানান দিতে হবে যে আমরা ভালো করছি এবং আমাদের এখানে বিনিয়োগ করলে আপনি যেকোনো দেশে মুক্তভাবে রপ্তানি করতে পারবেন। সেটা হাই-টেক, মিডল টেক শিল্প, মোটরগাড়ি শিল্প হোক কিংবা ইলেকট্রনিক শিল্প হোক। তাহলে বিদেশিরা দেখতে পারবেন যে বাংলাদেশে এলে তাঁদের সুবিধা হবে। না হলে আমরা গ্রহীতা দেশ হয়েই থাকব।

আসিয়ান ছয়টি রাষ্ট্র নিয়ে শুরু হয়েছিল। পরে সদস্যসংখ্যা বাড়িয়েছে। অনেক দেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ওই অঞ্চলে যারা সদস্য ছিল না, তাদের তারা সদস্য করে নিয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ আসিয়ানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। ভারত ঠিকই পেরেছে। অথচ আমাদের অর্থনীতির আকার বেড়েছে এবং তা ৪০০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। এই অর্থনীতি সবার নজর কাড়ার কথা। এটা তখনই সবার নজরে থাকবে, যদি আমরা কিছু অর্থনৈতিক জোটের সদস্য হতে পারি। হওয়া উচিত। অন্তত দ্বিপক্ষীয় হলেও ভালো।

আরেকটা বিষয়, আমাদের ইকোনমিক জোনগুলোতে থাকা বিদেশি কম্পানিগুলোর কথা শোনা উচিত। বিদেশি কম্পানিগুলো যখন অভিযোগ করে যে ‘বাংলাদেশ করপোরেট করের হার কম করে দেখায়, প্রকৃতপক্ষে তা অনেক বেশি’, তখন তা অবশ্যই আমলে নেওয়া উচিত। অভিযোগগুলো শোনা উচিত। এর জবাব সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে দেওয়া উচিত। সম্পূরক কর, সারচার্জ, নানা রকম অতিরিক্ত কর—এগুলোর ব্যাপারে সরকারের ব্যাখ্যা থাকা উচিত। না হলে বিদেশিদের বিনিয়োগে আগ্রহী করা যাবে না।

বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের অভিনন্দন যে তাঁরা ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছেন। একসময় এটা আমাদের স্বপ্ন ছিল। এখন স্বপ্নটি আরো বড় হয়ে গেল। আশা করি এফটিএ করে আমরা বিশ্বের নজর কাড়তে পারব। বিদেশের মার্কেটে আমাদের যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে, সেগুলো দূর করতে হবে। মোটকথা বাংলাদেশকে এখন রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, যেটা ভিয়েতনাম পেরেছে, তাইওয়ান পেরেছে, থাইল্যান্ড পেরেছে, মালয়েশিয়া পেরেছে। এগুলো এখন রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এ জন্য এফটিএ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক

 

 

সুত্রঃ কালের কন্ঠ