এক সিরিজ খেলেই বাদ পড়ায় যেভাবে নিজেকে বদলেছেন কোহলি

কথায় বলে ‘সকাল দেখেই নাকি বোঝা যায় দিনটি কেমন যাবে’- এ প্রবচনটি ভারতীয় অধিনয়ক বিরাট কোহলির ক্ষেত্রে তেমন প্রযোজ্য নয়। আজ যিনি বিশ্ব ক্রিকেটের এক নম্বর তারকা, তার শুরু দেখে কিন্তু মোটেই তা মনে হয়নি।

২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে প্রথম ভারতের আকাশী জার্সি গায়ে মাঠে নামা। ঐ সিরিজের সবকটা ম্যাচই খেলেছেন। পারফরমেন্স যে খুব খারাপ ছিল, তা বলা যাবে না। স্কোরগুলো ছিল ১২, ৩৭, ২৫, ৫৪ ও ৩১- তবু বাদ পড়ে যাওয়া এবং একবছর দলের বাইরে থাকা।

তারপর প্রায় ১৩ মাস পর ২০০৯ সালের সেপ্টেস্বরে আবার সেই শ্রীলঙ্কার মাটিতে এক ম্যাচ খেলার সুযোগ পাওয়া (২*)। সেখান থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে গিয়েই বদলে যায় ভাগ্যের চাকা।

ঐ আসরে জোহানেসবার্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১০৪ বলে ৭৯ রানের হার না মানা ইনিংস উপহার দিয়ে হন ম্যাচসেরা। সে বছরই কলকাতার ইডেন গার্ডেনে সেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি। ৩১৮ রানের বড় টার্গেট ছুঁতে গিয়ে গৌতম গাম্ভীরের সঙ্গে তৃতীয় উইকেটে ২২৪ রানের পার্টনারশিপ। ম্যাচে ভারত পায় ৭ উইকেটের দারুণ জয়।

নৈপুণ্যের বাতি যে জ্বলতে শুরু করল, তা এখনও জ্বলছে। আলো কমেনি একটুও। বরং দিনকে দিন বাড়ছে। সেই বিরাট কোহলি এক যুগের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ২৪৮ ম্যাচে ৪৩ সেঞ্চুরি আর ৫৮ হাফসেঞ্চুরির মালিক। টেস্টেও দুর্দান্ত; ৮৬ ম্যাচে ২৭ শতক আর ২২ অর্ধশতকে ৭২৪০ রান।

অনিশ্চিত শুরু, ১৩ মাস বাইরে থাকা, তারপর কিভাবে নিজেকে আবার মেলে ধরা এবং অপরিহার্য্যতার প্রমাণ দেয়া। সোমবার রাতে ফেসবুক লাইভে বিরাট কোহলির কাছে তামিম ইকবালের কৌতূহলি প্রশ্ন, আমি আপনাকে প্রথম দেখেছি ২০০৯ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। তার ঠিক ২ থেকে ৩ বছর পর পুরোপুরি বদলে যাওয়া এক ব্যাটসম্যান আপনি। এই নিজেকে বদলে ফেলার কাহিনীটি কী? ঐ সময়টায় আপনি কী করেছিলেন যা নিজেকে একদম পাল্টে দিয়েছে?

জবাবে বিরাট কোহলি অনেক লম্বা-চওড়া কথা বলেছেন, জানিয়েছেন অনেক কিছু। বুঝিয়ে দিয়েছেন, মূল বিষয় হলো মানসিকতা। সবার আগে দরবার ইতিবচিক মানসিকতা। আমার অভিজ্ঞতা কম, আমার সামনে অনেক অভিজ্ঞ উইলোবাজ, আমি তাদের ভিড়ে কী করব?- এসব সাত পাচ না ভেবে, নিজেকে মেলে ধরার তাগিদ থাকলে ঠিক পারফরম করা সম্ভব।

বিরাট কোহলি তার ক্যারিয়ারের শুরুর কাহিনী শোনাতে গিয়ে একদম গল্পের মত বলে গেলেন, অকপটে স্বীকার করলেন আর সবার মত শুরুতে তারও সংশয় ছিল, ‘আপনি যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা শুরু করবেন, তখন সবার মাঝেই একটা সংশয়, দ্বিধা থাকে যে কিভাবে ক্যারিয়ার তৈররি করব? কিভাবে সামনে এগিয়ে যাব। আমার সঙ্গে যেটা হয়েছিল, আমি এক সিরিজ খেলে পর বাদ পড়ে যাই। কিছুদিন দলের বাইরে কাটাতে হয়।’

‘পরে ২০০৯ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আবার সুযোগ আসে। সেবার ২-৩ ম্যাচ খেলার সুযোগ পাই, ভাল পারফরম করি। এক খেলায় ম্যান অফ দ্যা ম্যাচও হই। সেখান থেকেই আসলে আত্মবিশ্বাস আর আস্থা বাড়তে থাকে।’

‘তারপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরিটি হলো, বলার অপেক্ষা রাখে না আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেটাই ছিল আমার প্রথম শতরান, তখন থেকেই আমার ভেতরে একটা অন্যরকম বিশ্বাস ও আস্থা জন্ম নিল। মনে হলো আমি পারব, লম্বা সময়ের জন্য ভারতীয় দলের হয়ে খেলতে পারব, পারফরমও করতে পারব।’

বিরাট যোগ করেন, খেলার মাঠে ম্যাচ কন্ডিশনে পারফরম করেই নিজেকে তিলে তিলে গড়ার চেষ্টা করতে হবে। তার অনুভব, ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী পারফরম করলেই মন মানসিকতা পাল্টে যেতে পারে। এজন্য জন্য মানসিক প্রস্তুতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

একথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একজন নবীন ও তরুণ ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন চাপের মুখে পারফরম করতে পেরেছি, বড় রান তাড়ার চাপ সহ্য করেও রান করতে পেরেছি, তাহলে আমাকে দিয়ে হবে, আমি পারব। ম্যাচ পরিস্থিতিতে পারফরম করেই আসলে আপনার মন মানসিকতা পাল্টে যেতে পারে। পারফরমেন্স করার জন্যও একরকমের প্রস্তুতি দরকার। মানসিক প্রস্তুতিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন তরুণ হিসেবে আমি সবসময় ভাবি মাইন্ডসেটটা খুব ইতিবাচক ও ভাল রাখা জরুরি।’

তরুণদের প্রতি তার পরামর্শ, ‘কোন তরুণ ব্যাটসম্যানকে শুরু করতে দেখলে আমি বলি, তোমার সামনে যে ব্যাটসম্যান আছেন, তিনি কত অভিজ্ঞ, দেড়শ না দুইশ ম্যাচ খেলেছেন- এসব নিয়ে ভেবো না। তুমি তার চেয়েও ভাল পারফরম করতে পারো, ম্যাচও জেতাতে পারো। তোমার মাইন্ডসেট যদি ভাল হয়, অবশ্যই পারফরম করতে পারবে। তোমার দ্বিতীয় না তৃতীয় ম্যাচ- তা ধর্তব্য নয়। আমার চেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় আউট হবার পর কখনও ভাবিনি যে এখন কী হবে? আমি কী করবো? আমি চাপ না নিয়ে, ঘাবড়ে না গিয়ে বরং সেটাকে একটা সুযোগ হিসেবে দেখেছি। আমি ভেবেছি সে পারেনি তো কী হয়েছে? আমি চেষ্টা করে দেখি, পারতেও তো পারি। আমার যদি সেই আত্মবিশ্বাসটা থাকে তাহলে আমি নিশ্চয়ই পারব। এমন আস্থা আর আত্মবিশ্বাস খুব দরকার।’

এ বিশ্বসেরা উইলোবাজের শেষ কথা, ‘যেকোন পরিবেশ-প্রেক্ষাপটকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। আর এটিচিউড ঠিক রাখতে হবে। নিজের সামর্থ্যের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থাটা খুব জরুরি। যেকোন পরিস্থিতিকে ভিন্নভাবে দেখার মানসিকতা ও প্রবণতা থাকতে হবে। তা না হলে ভাল খেলা কঠিন। আপনি যদি ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পারেন, তাহলে আপনার পক্ষেও ম্যাচ জেতানো সম্ভব হবে। খেলার প্রতি মনোভাব ঠিক থাকলে এমনিই পারফরমেন্স ভাল হবে। আমি যাব, খেলব আর দলকে জেতানোর চেষ্টা করব- এমন ভেবে খেললে অবশ্যই পারফরমেন্স ভাল হবে।

 

সুত্রঃ জাগো নিউজ