এক পা এগিয়ে তো দুই পা পিছিয়ে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলে শিক্ষার্থীর চেয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু এই মাধ্যমিকে, এমনকি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও নারী শিক্ষকের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে কম। গত কয়েক দশকে সাক্ষরতার হার পুরুষের তুলনায় নারীদের বেশি হারে বেড়েছে। তবে এখনো নারী সাক্ষরতার হার পুরুষের চেয়ে ৫ শতাংশ কম।

ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রে নারীদের প্রাধান্য এখনো অটুট। কিন্তু নারী ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে পেছনের তালিকায় থাকা দেশটি বাংলাদেশ।

শিক্ষা-স্বাস্থ্য-রাজনীতিতে অংশগ্রহণ-আয় বা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নারীর এমন আশাজাগানিয়া আবার হতাশার চিত্র সমানভাবে চোখে পড়ে।

অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলছেন, ‘নারী উন্নয়নের চিত্রে আমরা একধরনের খণ্ডিত সূচকের অগ্রগতি দেখছি।’

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক নানা সূচকে পুরুষের সমানে সমান বাংলাদেশের নারীরা। এ চিত্র আশা জাগায়। কিন্তু রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, আয় বা কর্মসংস্থানে এখনো পুরুষের চেয়ে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশের নারীরা।

চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে যৌথভাবে সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন এজেন্সি (সিডা), ইউএন উইমেন এর ‘উইমেন অ্যান্ড ম্যান ইন বাংলাদেশ: ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারস ২০১৮’ নামের প্রকাশিত প্রতিবেদনে নারী-পুরুষের নানা ধরনের পরিসংখ্যান উঠে এসেছে।

এ গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যমান পরিসংখ্যান ভান্ডার থেকে লিঙ্গভিত্তিক উপাত্ত খুঁজে বের করা। আর লিঙ্গ সমতার প্রশ্নে এসব পরিসংখ্যানের ব্যবহার করা। পরিসংখ্যানগুলো নীতিনির্ধারণী পরিবর্তনে সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করবে, এ ধারণা থেকেই গবেষণা প্রতিবেদনটি করা হয়।

আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তিন দশক ধরে ক্রমাগত ভালো করছে। গড় আয়ুর নিরিখে এ অগ্রগতিকে চিহ্নিত করা যায়। পুরুষের চেয়ে বাংলাদেশে ১৯৮১ সালে নারীর গড় আয়ু ছিল ৫৪ দশমিক ৫ বছর আর পুরুষের ৫৫ দশমিক ৩ বছর। ৩৬ বছর পর এ চিত্র পাল্টে গেছে। ২০১৭ সালে নারীর গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে ৭৩ দশমিক ৫ বছর আর পুরুষের ৭০ দশমিক ৬। প্রতিবছর গড়ে নারীর গড় আয়ু বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫৩ বছর আর পুরুষের শূন্য দশমিক ৪৩ বছর।

বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার দিন দিন কমছে। আর দেখা যাচ্ছে নারীপ্রধান পরিবারের চেয়ে পুরুষপ্রধান পরিবারের দারিদ্র্যের হার বেশি। ‘উইমেন অ্যান্ড ম্যান ইন বাংলাদেশ: ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারস ২০১৮’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাঝারি দরিদ্র পরিবারের মধ্যে নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা শতকরা প্রায় ২০ শতাংশ। পুরুষপ্রধান এমন পরিবারের সংখ্যা প্রায় ২৯ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে নারীপ্রধান এসব পরিবারের সংখ্যা ২০ শতাংশ আর ২৭ শতাংশের বেশি পুরুষপ্রধান পরিবার। তবে শহরে নারীপ্রধান দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে সামান্য বেশি। পুরুষ প্রাধান্যের বাংলাদেশের সমাজে পুরুষপ্রধান পরিবারের সংখ্যা বেশি। কিন্তু সেই চিত্রও পাল্টাচ্ছে। এখন দেশের প্রায় ১৪ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার নারীপ্রধান। যেটা গত শতকের শেষ দশকে ৫ শতাংশের বেশি ছিল না।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়ে শিশুর ভর্তির পরিমাণ ছেলের চেয়ে বেশি। প্রতিবেদনে ব্যবহৃত উপাত্ত বলছে, প্রাথমিকে মেয়ে শিশু ভর্তির হার ৯৩ শতাংশের বেশি। আর ছেলে শিশুর ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশের মতো। মাধ্যমিকে মেয়েদের ভর্তির হার প্রায় ৭০ শতাংশ। কিন্তু ছেলেদের ৬০ শতাংশের কিছু বেশি। যদিও সার্বিকভাবে সাক্ষরতার হার পুরুষের তুলনায় নারীর কম এখনো।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীর হার যথাক্রমে প্রায় ৫১ ও ৫৪ শতাংশ। প্রাথমিকে নারী শিক্ষকের হার ৬২ শতাংশের বেশি। কিন্তু মাধ্যমিক, কলেজে নারী শিক্ষকের হার ২৬ শতাংশের মতো। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের হার ২৭ শতাংশ। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে নারী শিক্ষার্থীর হার প্রায় ৩৭ শতাংশ।

দেশে ছেলে নবজাতকের চেয়ে মেয়ে নবজাতকের মৃত্যুর হার কম। এক মাসের কম বয়সী প্রতি ১০০০ শিশুর বার্ষিক মৃত্যুর হারকে নবজাতকের মৃত্যুর হার হিসেবে ধরা হয়। ২০১০ সালে মেয়ে নবজাতকের মৃত্যুর হার ছিল ২৪ আর ছেলে নবজাতকের ২৮। ২০১৭ সালে উভয়ের সংখ্যা কমে এখন ১৭ তে দাঁড়িয়েছে।

 স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এমন অগ্রগতির চিত্রের পাশাপাশি বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে কিন্তু পুরুষের চেয়ে মেয়েদের বিয়ের হার ১০ গুণ বেশি। বাল্যবিবাহ নারীর শুধু আর্থসামাজিক নয়, স্বাস্থ্যের জন্যও এক স্থায়ী দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে। আবার নারীদের বিধবা হওয়ার হার যেখানে ৯ শতাংশ সেখানে পুরুষের বিপত্নীক হওয়ার হার ১ দশমিক ১ শতাংশ।

দেশের অর্থনীতির গতি সঞ্চারে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকার কথা জোরেশোরে উচ্চারিত হয়। বিবিএসের তৈরি ক্ষুদ্র ঋণ জরিপ (২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন) অনুযায়ী, ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে এখনো ৮৫ শতাংশ নারী। অন্যদিকে নারী কিন্তু ব্যবসায় ও উদ্যোক্তা হিসেবে অনেক পিছিয়ে আছে।

গত নভেম্বরে প্রকাশিত মাস্টারকার্ড ইনডেক্স অব উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউয়ারস (২০১৯) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ৫৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৭। এ তালিকায় বাংলাদেশের পরে আছে শুধু মিসর।

হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, নারীদের নিচের দিকের সুযোগগুলোতে প্রবেশাধিকার ঘটেছে। কিন্তু ওপরের দিকে তাঁরা এখনো অনেক পিছিয়ে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২০ তে বাংলাদেশের নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের সেই ১০টি দেশের একটি, যেখানে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে নারী সরকারপ্রধান ছিলেন। তবে নারীপ্রধান হিসেবে ক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো নারীদের অংশগ্রহণ অনেক কম।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সব পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা থাকলেও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে সেটা মাত্র ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটিতে নারী আছেন প্রায় ২৬ শতাংশ। একই অবস্থা অন্যান্য বড় দলগুলোর ক্ষেত্রেও।

তবে কমিটিগুলোতে ৩৩ শতাংশ নারী কোটা পূরণের জন্য সব দলই অবশ্য ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় পাচ্ছে।

নারীর অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী এ প্রবণতা আখেরে দেশের সার্বিক উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করবে, এ মন্তব্য জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী সুলতানার। তিনি মনে করেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি সরকারি নীতিতে পরিবর্তন আনা দরকার।