এক টাকার জিনিস তিন টাকায় ক্রয়!

স্বাধীনতা-উত্তরকালে দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতিতে অসহ্য হয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘চাটার দল’ সব শেষ করে দিচ্ছে। আরও অসহ্য হয়ে তিনি দুর্নীতিবাজদের ‘ফায়ারিং স্কোয়াডে’ বিচার করতে চেয়েছিলেন। না, সে সুযোগ তার আর হয়নি। বাংলাদেশবিরোধী শক্তি তাকে এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তিনি শহীদ হন।

বঙ্গবন্ধু যে যুদ্ধ ও বিচার করতে চেয়েছিলেন তার কন্যাও দেখা যাচ্ছে একই মনোভাব পোষণ করেন। তিনি চোরদের সম্পর্কে দু’দিন পরপরই সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন। তিন বছর আগে (০৩.০৭.১৭) সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির পর তিনি দুর্নীতি বন্ধের আহ্বান জানান। বড় বড় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবার দুর্নীতি-অপচয় বন্ধ করতে হবে।’

দুর্নীতি-অপচয় কীভাবে এবং কোথায় হয়, এ কথা তিনি ২০১৯ সালে (০৩.১০.১৯) এসে পরিষ্কারভাবে বলেন। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, ‘আমরা চলতি বাজেটে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। দুর্নীতিবাজ উইপোকারা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে অর্থ লুটে নিচ্ছে। দেশের উন্নয়নের জন্য জনগণের কষ্টার্জিত প্রতিটি পয়সার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য আমাদের ওইসব উইপোকাকে আটক করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘উইপোকাদের ছাড় নয়, অভিযান চলবে। …দল, আত্মীয়, পরিবার কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।’

প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উল্লেখিত উইপোকারা কীভাবে উন্নয়ন প্রকল্প থেকে টাকা লুট করে খায় তার সর্বশেষ খবরটি প্রকাশিত হয়েছে যুগান্তরে, জুলাইয়ের ২১ তারিখে। এর শিরোনাম : ‘থামছেই না অস্বাভাবিক দামের প্রস্তাব : একটি ড্রাম ১০ হাজার টাকা’। যুগান্তরের ‘থামছেই না’ বলার কারণ আছে। এর আগে আমরা ‘বালিশের’ কথা শুনেছি। রংপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১ হাজার ৩২০টি বালিশ কেনা হয়েছে। একেকটির দাম ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। প্রতিটি বালিশ নিচতলা থেকে ওপরে তোলার জন্য খরচ হয়েছে ৭৬০ টাকা। গোপালগঞ্জের একটি মেডিকেল কলেজের জন্য সাড়ে ৫ হাজার টাকা মূল্যের একটি বই স্বাস্থ্য দফতর কিনেছে ৮৫ হাজার টাকায়। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ‘আইসিইউ’তে ব্যবহারের জন্য পর্দার দাম ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা।

এ রকম উদাহরণ প্রতিদিন খবরের কাগজে ছাপা হয়। এটা এখন গা-সওয়া ব্যাপার। দেখা যাচ্ছে, কোথাও জিনিসপত্র কেনা হয়েছে, কোথাও তার জন্য বরাদ্দ চাওয়া হচ্ছে। যুগান্তরের সংশ্লিষ্ট খবরটি ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ নামীয় একটি উন্নয়ন প্রকল্প সম্পর্কিত। এতে দেখা যাচ্ছে, শুধু ড্রামের দাম নয়, প্রায় প্রতিটি জিনিসের দাম ধরা হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। যেমন একটি অ্যালুমিনিয়ামের বড় চামচের দাম ধরা হয়েছে এক হাজার টাকা। এক কেজি মসলা রাখার প্লাস্টিকের পাত্রের দাম দুই হাজার টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। যে প্রকল্পে এসব দাম ধরা হয়েছে এর মূল্যমান ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা।

খবর অনুযায়ী, প্রকল্পটিকে ‘জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি’ (একনেক) অনুমোদন দিয়েছে। কীভাবে এটা ঘটল তা খোঁজার জন্য ইতোমধ্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের অনুরোধে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। খবরে দেখলাম পরিকল্পনামন্ত্রী বলছেন, “আমার পক্ষে একটি একটি করে পৃষ্ঠা উল্টে দেখা সম্ভব হয় না। তবে আমি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যদের ওপর আস্থা রাখি। তারা সবকিছু ঠিক করে আমাকে দেন। আমি প্রকল্পগুলো ‘একনেকে’ নিয়ে যাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে।”

মন্ত্রী মহোদয় খারাপ বলেননি। তার পক্ষে সবকিছু দেখা সম্ভব নয়। দেখবেন কমিশনের সদস্যরা। প্রথমে দেখেছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তারপর বহু ‘ঘাট’ পেরিয়ে প্রকল্প এসেছে পরিকল্পনা কমিশনে। ‘কমিশনে’ রয়েছে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)। জবরদস্ত কমিটি বলা যায়। এত স্তর পেরিয়ে এমন অদ্ভুত প্রকল্প প্রস্তাব কী করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেল? সংশ্লিষ্ট বিভাগ, ধাপে-ধাপের অফিসাররা কী করলেন? এটা কীভাবে সম্ভব যে, একটা ড্রামের দাম ১০ হাজার টাকা? আমার বিচারে এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কথিত উইপোকাদের কারণে। উইপোকা এমন জিনিস, একটা মারলে দশটা হয়।

বলা হতে পারে, এটা তো প্রস্তাব। তারপর টেন্ডার হবে। টেন্ডার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। তারপর তো খরচ। এ কথা আমলে নিয়ে বলা যায়, প্রস্তাবের বিষয়টি হচ্ছে মার্ডারের পরিকল্পনা। খুন করার আগে পরিকল্পনা লাগে। চুরি, চামারি, দুর্নীতি, ডাকাতি করতে হলে পূর্বপ্রস্তুতি লাগে। হঠাৎ করেই ডাকাতি করা যায় না। আচমকা সরকারি অর্থ লুট করা যায় না। এর জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা লাগে। এটা সরকারি সব অফিসের বেলায়ই সত্য।

ব্যাংকের টাকা মারার ক্ষেত্রেও সত্য। প্রতিদিন সব ব্যাংক মিলে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণপত্র (এলসি) খোলে। পণ্য আমদানির জন্য। বেশিরভাগ ‘এলসি’ই এখন খোলা হয় চীনের ব্যবসায়ীদের অনুকূলে। তাদের সঙ্গেই আমাদের আমদানি ব্যবসা প্রচুর। এসব ক্ষেত্রে কী করা হয়? ওভার ইনভয়েসিং (অতি মূল্যায়ন) এবং আন্ডার ইনভয়েসিং (অব-মূল্যায়ন) করে টাকা বিদেশে পাচার করা হয়। এক টাকার পণ্যের দাম ২-৩ টাকা ধরা হয়।

টাকা চলে যায় রফতানিকারকের কাছে। আমদানিকারক পরে তা পেয়ে যায়। পুঁজি গঠন হয়ে গেল। এই যে ‘অতিমূল্যায়ন/অবমূল্যায়ন’- এটা টাকা চুরির অন্যতম মাধ্যম। এতে জড়িত থাকে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজনসহ ঊর্ধ্বতম পর্যায়ের লোকজন। বহু বিস্তৃত কর্মকাণ্ড এসব। ধরতে গেলেই হাত পুড়ে যায়। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিরোধ আসে। টেলিফোন আসে।

যুগান্তরের যে খবরটি নিয়ে আলোচনা করছি তা খুবই পরিষ্কার ডাকাতির ঘটনা। পণ্যের দাম বেশি ধরলে তাতে টেন্ডারদাতারা লাভবান হয়। তারা এসব খবর রাখে। সেভাবেই পণ্যের দর তারা তাদের টেন্ডারে উল্লেখ করে। এতে জড়িত থাকে বহু লোক, বহু বিভাগ। আর টেন্ডারদাতা কী করে? সে যে বেশি টাকা পায় তা টেবিলে টেবিলে ভাগ করে দেয়। অফিসে একে বলা হয় ‘টেবিল মানি’। ‘টেবিল মানি’ ছাড়া কোনো ফাইল অফিসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। কম-বেশি সবাই ‘পুরস্কৃত’ হয়। এ পুরস্কারটা ঊর্ধ্বতন পর্যায় পর্যন্ত চালু থাকে।

‘টেবিল মানি’কে বড় বড় কর্তারা ‘মটিভেশন’ মানি বলে। সাদা বাংলায় বলা যায়- ‘ঘুষ’। এই ঘুষ বা মটিভেশন মানি না দিলে কোনো কাজ হয় না। ‘ঘুষ’ কাজ করে অনুপ্রেরণা হিসেবে। এটা আজকের ঘটনা নয়। দীর্ঘকাল ধরে চলছে। চলার কারণও আছে। অন্যতম কারণ প্রভাবশালী লোকেরা এসব ঘটনাকে ছোট ঘটনা মনে করেন। যেমন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বালিশ-পর্দা ছিঁচকে কাজ’। বলাই বাহুল্য, সরকারি অফিস-আদালতে নিত্যদিনকার এসব ক্রয়ের কাজে সংঘটিত দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতিকে প্রভাবশালীরা ছোট চুরি মনে করেন। এ ধরনের মনোবৃত্তির কারণেই দুর্নীতির বিচার-আচার হয় না। আর চলে অবিরাম বেশি দামে কেনার কার্যক্রম।

আমার যতদূর মনে পড়ে, প্রয়াত শামস কিবরিয়া সাহেব অর্থমন্ত্রী থাকাকালে একবার বলেছিলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের টাকার প্রায় এক তৃতীয়াংশ চুরি হয়ে যায়। এটা অনেকটা ভদ্রভাবে বলা। কারণ একটা ড্রামের দাম যদি ১০ হাজার টাকা হয় তাহলে সরকারি খরচের অবস্থাটা কি ভাবা যায়? এটা আমাদের উন্নয়নের বড় একটা দুর্বল দিক। অর্থনীতিবিদরা তাই বলেন সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান বৃদ্ধি করার কথা। অর্থাৎ এক টাকার জিনিস তিন টাকা দিয়ে না কেনা।

অথচ বাস্তবে এক টাকার কাজ আমরা তিন টাকায়, দুই টাকা দিয়ে করছি। তাও বহুকাল ধরে। এতে আমাদের ‘উন্নয়ন কর্মসূচির’ ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। সরকারি খরচ তো শুধু ‘উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি)’ নয়। সরকারের রাজস্ব ব্যয়ও আছে। সেখানেও একই অবস্থা। জেলখানার কয়েদিরা বাইরে থেকে ভাত কিনে খায়। খাদ্য সরবরাহকারীরা সেই টাকা ভাগাভাগি করে খায়। হাসপাতালের খাবারের ক্ষেত্রেও তাই। রাজস্ব ব্যয়েও প্রচুর চুরি।

এ কারণে প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়ছে। মানুষের ওপর করের বোঝা চাপছে। আর আমরা বলছি রেকর্ড পরিমাণ বাজেট। অথচ কেউ বলছি না এক টাকার কাজ এক টাকায় করতে। যদি তা করা যেত তাহলে বর্তমান ‘এডিপির’ টাকা দিয়ে কমপক্ষে তার দ্বিগুণ কাজ করা যেত। অথচ তা সম্ভব হচ্ছে না। একশ্রেণির দুর্নীতিবাজরা সরকারি ব্যয়কে পুঁজি গঠনের মাধ্যম ধরে নিয়েছে। এর শেষ কোনোদিন কি হবে?

ড. আরএম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

rmdebnath@yahoo.com

 

সুত্রঃ যুগান্তর