একুশে পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মজিবুর রহমান দেবদাস আর নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক, জয়পুরহাট:
একুশে পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও অধ্যাপক মজিবুর রহমান দেবদাস নিরবে চলে গেলেন না ফেরার দেশে (ইন্না..রাজিউন)। সোমবার ভোর ৪টায় জয়পুরহাটের সদর উপজেলার ভাদসা ইউনিয়নের মহুরুল গ্রামের নিজ বাড়িতে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। মজিবর রহমানের দ্বিতীয় ভাইয়ের স্ত্রী রোকেয়া বেগম এ তথ্য জানান।


বেলা সাড়ে ১১টায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুস সালাম, সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিল্টন চন্দ্র রায়,সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহরিয়ার খান, ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি,তদন্ত) সুজন মিয়ার উপস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মরদেহে রাষ্ট্রীয় সালাম শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় একুশে পদকপ্রাপ্ত এই বুদ্ধিজীবীকে।

মজিবর রহমান ১৯৩০ খৃষ্টাব্দের ১ লা জানুয়ারী ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভূক্ত জয়পুরহাট জেলার সদর উপজেলার জয়-পাবর্তীপুর মহুরুল গ্রামে পিতা: ওসমান গনি,মাতা:ফারতুন্নেসা আখতার এর তিন সন্তান এর মধ্যেপ্রথম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি ১৯৪৬ খৃষ্টাব্দে খঞ্জনপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে(ক্যালকাটা বোর্ডে ৭ম) ম্যাট্রিক পাশ করেন। এইচএসসি- প্রথম বিভাগ (ক্যালকাটা বোর্ডে ১১তম), বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে স্নাতক- ডিস্টিংশন সহ পাস, গণিত এ ঢাবি থেকে এমএ (প্রথম শ্রেণিতে প্রথম), অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ফলিত গণিতে এমএসসি পাশ করার পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজে শিক্ষকতা করেন, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের করাচী শহরের নাজিমাবাদ কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে অষ্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ^বিদ্যালয় থেকে মজিবর ফলিত গণিত এমএসসি ডিগ্রী লাভ করেন, ১৯৬৭ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে মজিবর রহমান বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট একটি চিঠি পাঠালে বিশ^বিদ্যালয় কর্তপক্ষ এই চিঠি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পাঠিয়ে দেয়।চোখের সামনে পাকিস্তানিরা এ দেশের বাঙ্গালী মুসলমানদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে। জীবন রক্ষার্থে অনেকেই যখন হিন্দু নাম বাদ দিয়ে মুসলিম নাম রাখা শুরু করেছিল তখন গণহত্যার প্রতিবাদ ও ক্ষোভে পিতা-মাতার দেয়া ইসলামী নাম এফিডেফিটের মাধ্যমে মজিবর রহমান পরিবর্তন করে নিজের নামের শেষে দেবদাস যুক্ত করেন।

১৯৭১ সালের ১২ই মে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং সেনা ছাউনিতে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করায় মজিবর রহমান পরবর্তীকালে তার স্মৃতিশক্তি হারান। স্বাধীনতার পরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ক্ষমতায় থাকায় মজিবর রহমানের কেউ খবর রাখেনি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও স্মরণ করেনি। বরং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাক বাহিনীর হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়া এই বুদ্ধিজীবীকে পাগল বলে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে চিকিৎসার নামে আরও নির্যাতন চালানো হয় বলে জানান তার পরিবার।

এর পর থেকেই জয়পুরহাটের সদর উপজেলার মহুরুল গ্রামে নিজ বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে নিংসঙ্গ জীবন কাটছিল বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মজিবরের। দেখভাল করতেন দ্বিতীয় ভাইয়ের স্ত্রী রোকেয়া বেগম, নাতনী অর্থিসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা।

বিছানা ছেড়ে কখনো হুইল চেয়ারে ঘরের বারান্দা পর্যন্ত বিচরণ সীমাবদ্ধ। কখনও কখনও বির বির করে আনমনে কথা বলতেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। কথা স্পষ্ট করে বলতে না পারলেও এই বুদ্ধিজীবী নিয়মিত পত্রিকা পড়ার পাশাপাশি হাতে থাকা ঘড়িতে সময় দেখে খাওয়া-দাওয়া করতেন ও ঘুমাতেন।

১৯৯৮ খৃষ্টাব্দের ২ রা আগষ্ট রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় মজিবর রহমানকে সংবর্ধনা দেয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাষ্ট সদস্য মফিদুল হক তাকে নিয়ে কান পেতে রই নামক একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরী করেন, ১২ জুন ২০০৯ বাংলাদেশ গণিত সমিতি কর্তৃক বিশেষ সম্মাননা প্রদান ২০১৫ খৃষ্টাব্দের ১৯ শে ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক পুরস্কার প্রদান করেন।

স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর ২০১৫ সালে এই গুণীকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক প্রদান করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেবদাসের পক্ষে তাঁর ভাতিজী দিলরুবা খানম বিউটী প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক গ্রহণ করেছিলেন।

চিরকুমার মজিবর রহমান দেবদাসের মৃত্যুতে জয়পুরহাটবাসী এই রকম একজন গুনী মানুষকে হারাল, এছাড়াও সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ সুধি সমাজে শোকের ছায়া নেমে আসে।