একনজরে সাবেক পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত

টেকনাফে চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার ঘটনায় আলোচনায় উঠে আসেন বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত হোসেন।

পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের পূর্ব হুলাইন গ্রামে লিয়াকতের বাড়ি। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে লিয়াকত পঞ্চম।

ওই গ্রামের মৃত মো. সাহাব মিয়ার ছেলে লিয়াকত ২০১০ সালে পুলিশে যোগ দেন। লিয়াকত প্রথমে ডিবি, পরে সোয়াত ও অ্যান্টি টেরিরিজম ইউনিটে কাজ করেন।

দুই বছর আগে পুলিশ পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান এবং এক বছর আগে টেকনাফ থানায় যোগদান করেন তিনি।

জানা গেছে, লিয়াকত প্রথমে চন্দনাইশ উপজেলায় বিয়ে করেন। ওই স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পর বোয়ালখালীতে আরেক বিয়ে করেন। ওই ঘরে তার দুই বছরের এক ছেলে রয়েছে।

গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকায় চেকপোস্টে সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত হোসেনের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

টেকনাফ থানার ওসির নির্দেশ পাওয়ার পরই তিনি সিনহাকে গুলি করেন। এ সময় সিনহার সহযোগী সিফাতকে আটক করেন।

ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মেজর (অব:) সিনহার বোনের আদালতে মামলার পরেই আলোচনায় আসে লিয়াকত আলীর নাম। এর পরেই অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসতে থাকে লিয়াকতের একের পর এক কাহিনী।

ওই তদন্ত কেন্দ্রে যোগদানের সাত মাসের মধ্যেই তিনি এলাকায় মূর্তমান আতঙ্ক হয়ে ওঠেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ- মাদক ব্যবসায়ী ও মানবপাচারের অভিযোগ তুলে অনেকের কাছ থেকেই চাঁদা আদায় করতেন তিনি।

এছাড়া এলাকার বেশ কয়েকটি ফিশারিজ ঘাট থেকেও নিয়মিত মাসোহারা আদায় করতেন। পাশাপাশি প্রদীপের মতো টাকা নেয়ার পরও ক্রসফায়ারে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে লিয়াকতের বিরুদ্ধেও।

ঘটনার পর কক্সবাজার পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, রাশেদ তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে। তবে পুলিশের এমন ভাষ্য নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ওঠে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তার এক সঙ্গীর বক্তব্যের সঙ্গে পুলিশের ভাষ্যের অমিল রয়েছে বলে একটি সূত্র জানায়। এমন প্রেক্ষাপটে পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখতে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৮ জানুয়ারি বাহারছাড়া তদন্ত কেন্দ্রে যোগদান করেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত হোসেন। ওসি প্রদীপের প্রশ্রয়ে নিজেও এলাকায় গড়ে তোলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট।

গত ২৫ এপ্রিল তিনি মানব পাচারের অভিযোগে নোয়াখারীপাড়া গ্রামের আবদুল হাকিমের ছেলে আবদুস সালামকে তুলে আনেন। এরপর ওই পরিবারের কাছ থেকে সাড়ে আট লাখ টাকা নেন।

কিন্তু ২৬ এপ্রিল তিনি সালামকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেন বলে পরিবারের অভিযোগ। এ ঘটনার পর এলাকার সবাই লিয়াকত ভয়ে তটস্থ থাকতেন।

স্থানীয় শামলাপুর দক্ষিণ ঘাটের সভাপতি বেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা প্রতি ঘাট থেকে পুলিশের জন্য খরচ দিতাম। শুরুতে ঘাটপ্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা করে দেয়া হতো। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না লিয়াকত ও তার সহযোগীরা।

টাকা কম হওয়াতে মা-বোন ধরে গালিগালাজ করতেন। পরে টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়।

স্থানীয় একটি ফিশারিজ ঘাটের নৌকার মালিক রাশেদুল আলম জানান, তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত হওয়া ইনচার্জ লিয়াকত দায়িত্বে থাকাকালে পুলিশের খাবারের কথা বলে আমার কাছ থেকে টাকা ছাড়াই মাছ নিতেন।

যত মাছ নিতেন এত মাছ তাদের প্রয়োজন হতো না। মাছ জমা করে ক্যাশিয়ার মামুনের মাধ্যমে সেগুলো বিক্রি করতেন লিয়াকত। তিনি জানান, শামলাপুর বাজারে ৩০টি মাছের আড়ত রয়েছে।

এসব আড়তে প্রতিদিন ৩০-৫০ জন ব্যবসায়ী মাছ কিনতে আসেন। এসব ছোট মাছ ব্যবসায়ী থেকে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা থেকে চাঁদা নিতেন।

চাঁদা না দিলে মাছের ভেতর ইয়াবা রয়েছে বলে মাছ রাস্তায় ছিটিয়ে দেয়াসহ নানাভাবে হয়রানি করতেন। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের ফাঁড়িতে নিয়ে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে আদায় করতেন লিয়াকত।

শামলাপুরের টমটম চালক সরওয়ার কামাল জানান, প্রত্যেক টমটম গাড়ি থেকে মাসে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা নিতেন লিয়াকত। করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউন চলাকালে ৫০০ টাকার জন্য আমার গাড়ির সামনের গ্লাসটি ভেঙে ফেলেন পরিদর্শক লিয়াকত।

এরপর টাকা নিয়েই তিনি গাড়িটি ছেড়েছেন। শুধু তাই নয়, গ্রাম্য সালিশ থেকেও হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিতেন লিয়াকত ও তার সহযোগীরা।

এদিনে সিনহা রাশেদের মৃত্যুর ঘটনার পর তদন্তের স্বার্থে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত হোসেনসহ ১৬ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে সিনহা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করে র‌্যাব।

৫ আগস্ট বুধবার কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন মেজর সিনহার বড়বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস।

এই মামলায় ৭ পুলিশ সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। তারা এখন কারাগারে আছেন। তাদের র‌্যাব হেফাজতে নিয়ে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে।

 

সুত্রঃ যুগান্তর