ইয়াবার কাঁচামাল পাচারে ঢাকা-চেন্নাই সিন্ডিকেট

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

 

কয়েক বছর আগেই বিয়ে করেছেন জুনায়েদ ইবনে সিদ্দিকী। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইনে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা রয়েছে তার শ্বশুরের। ২০১৭ সালে শ^শুর মারা যাওয়ার পর তিনিই সেই ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব পান। এর মধ্যে চেন্নাইয়ের কেমিক্যাল ব্যবসায়ী হাবিব মাস্টারের সঙ্গে বাহরাইনে পরিচয় হয়। দিন দিন বাড়ে ঘনিষ্ঠতা, বন্ধুকে বাংলাদেশে বেড়াতে আসারও আমন্ত্রণ জানান জুনায়েদ। এক সময় ঢাকায় এসে ওই ভারতীয় তাকে নতুন ব্যবসার প্রস্তাব দেন। এতে রাজিও হন জুনায়েদ।

পরে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ ওরফে বান্টি, ভারতীয় নাগরিক রাজখান এবং সতীশের সঙ্গে বন্ধু হাবিবকে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। আর ওই পরিচয়ের সূত্রেই একটি অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। পরে ঢাকাকে ট্রানজিট রুট বানিয়ে ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান এমফিটামিন পাউডার চোরাচালান শুরু করেন তারা। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে ১২ দশমিক ৩২০ কেজি এমফিটামিন জব্দের মামলার তদন্তে নেমে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য পেয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এমফিটামিন পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক চক্রটি। মূলত এক বছর ধরে চেন্নাই থেকে কলকাতা হয়ে বিপুল পরিমাণ এই পাউডার ঢাকায় পৌঁছেছে। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে সেগুলো কাস্টমস থেকে খালাস করা হয়। পুনরায় প্যাকিং করে অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে চালান করা হয়েছে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। ইয়াবা তৈরির এই মূল উপাদান বাংলাদেশ ও ভারত দুদেশেই নিষিদ্ধ। ডিএনসির তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা হয়ে গত এক বছরে প্রায় ৬শ কেজি এমফিটামিন পাউডার পাচার হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গেছে অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায়। কোটি টাকা কেজি বিক্রি হওয়া এমফিটামিন প্রতি চালানে যেত ২০ কেজি করে। সেই হিসাবে ৬শ কোটি টাকার এই পাউডার পাচার হয়েছে ঢাকা থেকে। আর দেশের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি কেজিতে জুনায়েদ পেতেন এক লাখ টাকা করে।

এমফিটামিন জব্দের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএনসি। তাদের মধ্যে ছয়জন এরই মধ্যে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। জেলে থাকা অপর সাতজন হলেন- মিটফোর্ড এলাকার কেমিক্যাল ব্যবসায়ী ও মাস্টারমাইন্ড আবুল কালাম আজাদ ওরফে বান্টি এবং তার সহযোগী রেজাউল হক বাবলু, জুনায়েদ ইবনে সিদ্দিকী, নজরুল ইসলাম, বাবুল মজুমদার, মো. বাপ্পী ও মো. মাজেদ।

ডিএনসি কর্তৃপক্ষ জানায়, চাঁদপুরের ছেলে জুনায়েদ ইবনে সিদ্দিকী বিবিএ পাস। ২০১৮ সালে বাহরাইনে তার সঙ্গে হাবিব মাস্টারের দেখা হয়। পরে ২০১৯ সালে ঢাকায় আসেন হাবিব। ঢাকার একটি হোটেলে তাদের মধ্যে বৈঠক হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসির এক কর্মকর্তা জানান, হাবিব মাস্টার কলকাতা থেকে বেনাপোল বন্দরে চালান পাঠাতেন। আর বান্টির দায়িত্ব ছিল সে চালানটি নিরাপদে ঢাকায় নিয়ে আসা। পরে সেগুলো জুনায়েদের বাসায় প্যাকিং করে বিভিন্ন দেশে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানো হতো। সতীশ এই প্যাকিংয়ের কাজে অত্যন্ত দক্ষ। বিমানবন্দরে এমফিটামিন পাউডারের চালানটি ধরা পড়ার কারণও ত্রুটিপূর্ণ প্যাকিং। সেটি অবশ্য সতীশ করেননি। তার অবর্তমানে অন্য একজন করেছিলেন।

এদিকে বিপুল পরিমাণ এমফিটামিন পাউডার পাচারচক্রে বন্দরের কিছু অসাধু কর্মকর্তাও জড়িত রয়েছেন বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আন্তর্জাতিক এই মাদকচক্রের বিদেশি নাগরিকদের ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে ডিএনসি। তদন্ত সূত্র জানায়, বাহরাইনে ব্যবসা থাকার সুবাধে জুনায়েদ বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াতেন। এ কারণে মাদকব্যবসায়ী হিসেবে তাকে কম সন্দেহ করা হতো। আর এ সুযোগটিই কাজে লাগতেন তিনি। ডিএনসির এক কর্মকর্তা বলেন, পুরান ঢাকার অনেক ব্যবসায়ী ভারত থেকে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল আমদানি করেন। এসবের আড়ালে অন্য কিছু আসে কিনা, সেটির নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।

জানতে চাইলে মামালার তদন্ত কর্মকর্তা ও ডিএনসির পরিদর্শক ফজলুল হক খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই সবকিছু বলা যাবে না।’ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ উল আহসান বলেন, ‘আমরা সিসিটিভি এবং জনবল আরও বাড়িয়েছি। এ ছাড়া এক্স-রে মেশিনও বাড়ানো হচ্ছে। নিরাপত্তায় আমাদের কোনো ঘাটতি রাখা হচ্ছে না।’

 

সূত্র: আমাদেরসময়