ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ: নির্যাতিত যখন নির্যাতক

ইতিহাস মাঝেমধ্যেই অত্যন্ত নির্মমভাবে ফিরে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নির্বিচারে ইহুদি গণহত্যার দায়ে পরাজিত জার্মানরা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছিল। ইহুদিদের ওপর জার্মান নাৎসিদের জুলুম–নির্যাতনকে কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু আইন করে বলা হলো হলোকাস্টকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। নানাভাবে ইহুদিদের সুরক্ষা দেওয়া হলো। কিন্তু এরপর যা হলো তা আরও ভয়ংকর, যা নাৎসিদের থেকে কোনো অংশেই কম না। জুলুম–নির্যাতন করে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করা হলো। নাৎসিরা ইহুদিদের হত্যা করে জার্মানি থেকে একরকম বের করে দিয়েছিল। ইউরোপে মার খাওয়া ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের মেরে, দখল করে নিজস্ব রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করল ১৯৪৮-এ।

সেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্তের অনুমোদন দিয়েছেন। এ মাসের শুরুর দিকে আইসিসির প্রিট্রায়াল চেম্বারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক এই মতামত প্রদান করেন। এতে বলা হয়েছে দখলকৃত পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা উপত্যকায় যুদ্ধাপরাধ তদন্তের জন্য যথেষ্ট প্রমাণাদি পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আইসিসি পরিপূর্ণ তদন্ত করতে পারে।

এর আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি ফাতৌ বেন সাওদা নিশ্চিত করেন পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যথেষ্ট আলামত রয়েছে। এরপরই সবাই নড়েচড়ে বসেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আইসিসির যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ফিলিস্তিনিদের কৌশলগত বিজয় বলে মানবাধিকারকর্মীরা মনে করছেন। কারণ, আইসিসিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করা অবিশ্বাস্য এক কঠিন কাজ। নানা ধরনের তদবির ও চাপকে উপেক্ষা করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে। অনুমেয় কারণেই আইসিসি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্ত করতে গড়িমসি করছিল। কারণ হচ্ছে ইসরায়েলি লবির চাপ। যুদ্ধাপরাধ অভিযোগের প্রাথমিক তদন্ত করতেই আইসিসি পাঁচ বছর সময় নিয়েছে।

নতুন সিদ্ধান্তের কারণে হেগের আদালতটি এখন ২০১৪ সালে ইসরায়েলের গাজা হামলা ও ২০১৮ সালে ফিলিস্তিনিদের নিজ বাসভূমে ফিরে যাওয়ার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা ও যুদ্ধাপরাধ খতিয়ে দেখবে। ২০১৮ সালে গাজার ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েল সীমান্তজুড়ে বিক্ষোভ করেছিল। তারা নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার দাবিতে মহা প্রত্যাবর্তন কর্মসূচি পালন করে। তবে বিক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সীমান্তেই থামিয়ে দিয়েছিল স্নাইপারের গুলিতে। এই নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি হত্যাই যুদ্ধাপরাধ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।

আইসিসির এই সিদ্ধান্তে ইসরায়েল অবশ্যই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। যদিও আইসিসি ইসরায়েলের পাশাপাশি হামাসের বিরুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করবে। কিন্তু দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আইসিসির বিরুদ্ধে ভুয়া যুদ্ধাপরাধ তদন্তের অভিযোগ করছেন। সর্বশক্তি দিয়ে আইসিসির তদন্ত আটকানোর ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। কট্টরপন্থী ইহুদি নেতারা আইসিসির সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম তীরের গ্রামগুলো মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছেন।

নেতানিয়াহুসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা আইসিসির বিরুদ্ধে সেমেটিক বিরোধী আচরণের অভিযোগ এনেছেন এবং ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে যুদ্ধাপরাধীর নমুনা আছে, এমন সন্দেহ করাটাকেও হলোকাস্ট অস্বীকার করার নামান্তর বলে অভিযোগ করেছেন। ইসরায়েল মনে করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের ওপর সংঘটিত অত্যাচার–নির্যাতন তাদের একধরনের ইনডেমনিটি দিয়েছে। ইসরায়েল এখন যা কিছুই করছে, সবই ইহুদি জাতির কল্যাণ ও রক্ষার জন্য। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। প্রশ্ন করলেই অ্যান্টি সেমেটিক বলে বিবেচিত হবে।

এসব অভিযোগের পাশাপাশি ইসরায়েল সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে রাখছে। প্রথমত, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের যেসব ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠতে পারে, সম্ভাব্য গ্রেপ্তার এড়াতে তাদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে সতর্ক করেছে। ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎস-এ একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি এখন সাধারণ নাগরিকদের দিয়ে পশ্চিম তীর দখল করছে। আগে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন এলাকা দখল করে বসতি গড়ে দিত। এখন ইসরায়েলের সাধারণ নাগরিকেরা গিয়ে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে বা কৃষিজমি দখল করছে। বাধা দিলে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের নাগরিকদের ওপর হামলার অভিযোগ করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের আটক করছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।

দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আইসিসির ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছে ইসরায়েল। বিভিন্ন দেশে যেসব সংগঠন ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কথাবার্তা বলছে, তাদের অ্যান্টি সেমেটিক তকমা লাগিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা–সেমিনার পর্যন্ত বাতিল করে দিচ্ছে। বিদেশে অবস্থানকারী ফিলিস্তিনের নাগরিকেরা গুপ্ত হামলার শিকার হচ্ছে। জায়নবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইসিসির বিরুদ্ধে সক্রিয় করা হচ্ছে। এমনকি অনেকে আইসিসির কৌঁসুলি ও বিচারকদের প্রাণহানিরও আশঙ্কা করছেন।

এ ছাড়া ইতিমধ্যেই ট্রাম্প প্রশাসন ফাতৌ বেন সাওদার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। বর্তমানে বাইডেন প্রশাসন এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে বলে মনে হয় না। বরং আইসিসির সিদ্ধান্ত বাইডেন প্রশাসনকে আরও বিপাকে ফেলে দেবে। বাইডেন বৈশ্বিক মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাক্‌স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। বাইডেন প্রশাসন কি ইসরায়েলকে রক্ষা করবে, না ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার রক্ষা করবে। একধরনের দোটানার মধ্যে আছে তারা। এ ছাড়া বাইডেনের পক্ষে পূর্ব জেরুজালেম থেকে দূতাবাস ফিরিয়েও আনা সম্ভব হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আরবের রাজনীতিতে আগের অবস্থান ফিরে পাওয়া সহজ হবে না।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। সম্প্রতি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার যে প্রবণতা আরব দেশগুলোতে শুরু হয়েছিল, তাতে ভাটা পড়তে পারে। ইসরায়েলের অঘোষিত ও বিশ্বস্ত মিত্র সৌদি আরব সব থেকে বেশি বিপাকে পড়বে। ইসরায়েল সমস্যায় পতিত হওয়া মানে সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতার আসন টলে যাওয়া। কোনো কারণে যদি ইসরায়েল দুর্বল হয়ে যায়, রাতারাতি সৌদি আরবে ক্ষমতার পালাবদল হবে। আর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইরান, তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে।

শেষ পর্যন্ত আইসিসি কত দূর তদন্ত করতে পারবে এবং কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। প্রাথমিক তদন্ত করতেই পাঁচ বছর লেগেছিল। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করতে এখন কত দিন লাগে, তদন্তকারীরা আদৌ কিছু করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তদন্তের ফলাফল যা–ই হোক না কেন, ফিলিস্তিনে কী হচ্ছে, সারা বিশ্বই তা দেখছে। ইসরায়েল হয়তো শেষ পর্যন্ত তদন্ত আটকে ফেলতে পারবে বা দীর্ঘায়িত করবে। কিন্তু আইসিসির সিদ্ধান্ত তাদের দখলদারির ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর তাদের জুলুম, নির্যাতনকে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে তুলে ধরেছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি অন্তত পাওয়া গেল।

ইসরায়েলের বিচার বা সাজা এখন সম্ভব না হলেও এই স্বীকৃতি ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। সময়ের পাতায় লেখা থাকবে যুদ্ধাপরাধের শিকার হওয়া ইহুদিরা নিজেরাই যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছিল। ফিলিস্তিনিদের রক্তে ভেসে গিয়েছিল গাজা, নাবলুস, রামাল্লার সবুজ প্রান্তর, রাজপথ। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে গিয়ে চোখ হারিয়েছিল ফিলিস্তিনের কিশোর, যুবক। পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল অসংখ্য ফিলিস্তিনি। জীবন দিয়ে দ্বিতীয় যুদ্ধে ইউরোপীয় নির্মমতার দায় শোধ করেছিল। নির্যাতিত ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্রের আড়ালে নির্যাতকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিল।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

সুত্রঃ প্রথম আলো