রবিবার , ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ | ২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

ইনুওরেসিস: বিছানা ভেজানো যখন রোগ

Paris
ডিসেম্বর ৩০, ২০১৮ ৪:৫০ অপরাহ্ণ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
রাতুলের (ছদ্মনাম) বয়স আট বছর। বাড়ির পাশের একটি বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ছে সে। পড়ালেখায় মনোযোগী রাতুল অত্যন্ত শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের ছেলে, তেমন কোনো বদঅভ্যাসও নেই তার। তবে ইদানীং রাতুলের একটি শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। তা হলো সে প্রতি রাতে বিছানায় মূত্রত্যাগ করে ফেলে। রাতুল বুঝতে পারছে বিষয়টি খুবই বিব্রতকর, কিন্তু লজ্জায় কাউকে বলতেও পারছে না। পাছে কেউ যদি বলে বসে, ‘এত বড় ছেলে, এখনো রাতে বিছানা ভেজায়!’। সেইসাথে বাবা-মার বিরক্ত ভাব, আর বন্ধুদের টিটকারি তো রয়েছেই।

নিজের এ সমস্যা নিয়ে রাতুল খুবই চিন্তিত। বিছানা ভেজানোর ব্যাপারটি এড়ানোর জন্য সে পানি বা তরল পদার্থ কম পান করে, রাতের বেলায় না ঘুমিয়ে জেগে থাকে। কিন্তু এসব করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। উল্টো শরীরের প্রতি অযত্ন অার অবহেলার কারণে রাতুলের স্বাস্থ্য ও পড়ালেখা দুটোই ভেস্তে যেতে বসেছে। রাতুলের মতো অনেক কিশোর-কিশোরীই কৈশোরে এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকে। বিছানায় প্রস্রাব করার এই সমস্যাটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় নকচারনাল ইনুওরেসিস বলে।

ইনুওরেসিস কী?

জন্মের পর ২-৩ বছর পর্যন্ত ঘুমের মধ্যে মূত্রত্যাগ শিশুদের জন্য একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ মলমূত্র ধরে রাখার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক, যা তিন বছর বয়সের অাগ পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে পরিপক্ব হয়ে ওঠে না। কিন্তু এ বয়সের পরে যদি কোনো শিশু বিছানায় মূত্রত্যাগ করে, তবে সেটিকে নকটারনাল ইনুওরেসিস বলে।

বিছানা ভেজানো যঝন রোগ

আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স এর মতে, ৫ বছর বয়সের ২০%, ৭ বছর বয়সের ১০% এবং ১০ বছর বয়সের ৫% শিশু বিছানা ভেজায়। সাধারণত কিশোরীদের তুলনায় কিশোররা এ রোগে বেশি ভোগে। কেননা কোনো কিছু শেখার জন্য যে কন্ডিশনিং (Conditioning) এর প্রয়োজন তা কিশোরীদের ক্ষেত্রে সহজে ঘটে। নকটারনাল ইনুওরেসিসকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়।

প্রথমটি হলো প্রাইমারি নকটারনাল ইনুওরেসিস। যখন শিশুর বিছানা ভেজানোর স্বাভাবিক বয়সসীমা পার হয়ে গেছে, কিন্তু শিশু এখনো বিছানা ভেজানো বন্ধ করেনি। অন্যটি হলো সেকেন্ডারি নকটারনাল ইনুওরেসিস। বিছানা ভেজানোর স্বাভাবিক বয়স সীমা পার হওয়ার কমপক্ষে ছ’মাস পর শিশু পুনরায় বিছানা ভেজানো শুরু করে। এছাড়াও কিছু বিশেষ প্রকারের ইনুওরেসিস অাছে।

প্রতিশোধপরায়ণ ইনুওরেসিস (Revenge Enuresis)

অভিভাবক যখন শিশু মানসিকভাবে পরিপক্ক হয়ে ওঠার আগেই শিশুকে জোরপূর্বক টয়লেটে গিয়ে মূত্রত্যাগের প্রশিক্ষণ দেয়ার চেষ্টা করেন। তখন এই কড়াকড়ি ভাব থেকে শিশুর অবচেতন মনে প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব তৈরি হয়। এই প্রবণতা থেকে বিছানায় মূত্রত্যাগ করা চালিয়ে যেতে থাকে বলে মনে করা হয়।

প্রত্যাবর্তী ইনুওরেসিস (Regressive Enuresis)

এটা সাধারণত তখনই ঘটে যখন পরবর্তী সন্তানের প্রতি বাবা মা অতিরিক্ত যত্ন নেয়া শুরু করেন এবং শিশু মনে করে, নবজাতকের জন্য তার প্রতি বাবা মায়ের আকর্ষণ কমে গেছে।

ক্রিয়াকৌশল

স্বাভাবিক অবস্থায় জন্মের পর ২-৩ বছর পর্যন্ত দেহের মেরুদণ্ডের স্নায়ুতন্ত্রের সেকরাল প্লেক্সাস নামক অংশটি মূত্রত্যাগ প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে। এজন্য এ বয়স পর্যন্ত শিশু ঘনঘন মূত্রত্যাগ করে এবং মূত্রত্যাগের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

মূত্রত্যাগ প্রক্রিয়া

তিন বছর পর মস্তিষ্কের মূল অংশ নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। ফলে মূত্রত্যাগ প্রক্রিয়াটিও নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আর এ প্রক্রিয়াটি যদি দেরি হয় অথবা কোনো কারণে এর নিয়ন্ত্রণ স্নায়ুসন্ধিতেই বিদ্যমান থাকে, তখনই বিছানায় মূত্রত্যাগ করার উপসর্গ দেখা দেয়। নকটারনাল ইনুওরেসিসের কারণ সমূহকে মোটা দাগে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।

শারীরিক কারণ

  • মূত্রনালীতে রোগ জীবাণুর সংক্রমণ ঘটলে ইনুওরেসিস হতে পারে।
  • মূত্রথলির ধারণ ক্ষমতা কিংবা সেটির কার্যকারিতা হ্রাস পেলে।
  • মূত্রনালির স্নায়ুতন্ত্র পূর্ণতা বা পরিপক্কতা পেতে দেরি হলে।
  • মূত্রতন্ত্রের গঠনগত সমস্যা যেমন ক্ষুদ্র বৃক্ক বা কিডনি, একাধিক বৃক্কনালি বা ইউরেটার থাকলেও ইনুওরেসিস হতে পারে।
ইনুওরেসিস এর কারণ

মানসিক ও পারিপার্শ্বিক প্রভাব

  • ঘুমাবার অাগে মূত্রত্যাগ না করে ঘুমাতে যাওয়া।
  • নিদ্রাজনিত বৈকল্য বা স্লিপ ডিজঅর্ডার।
  • শিশুকে অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে টয়লেট ট্রেনিং করানো।
  • শিশুর প্রতি বাবা-মায়ের নেতিবাচক কিংবা উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন।
  • পরিবারে অশান্তি ইত্যাদি।

জিনগত প্রভাব

দেখা গেছে, বেশিরভাগ ইনুওরেসিস রোগীর ৭০% নিকটাত্মীয়েরও এই রোগ থাকে। এছাড়াও গবেষকরা ইনুওরেসিসের সাথে যুক্ত দুটি জিনকে চিহ্নিত করেছেন। এগুলো ক্রোমোসোম ১২ এবং ১৩ এ অবস্থিত।

রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

কিডনি ফেইলিউর, হার্ট ফেইলিউর, ডায়াবেটিস, মৃগীরোগ, স্পাইনা বাইফডা ইত্যাদি রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ইনুওরেসিস হতে পারে। নকটারনাল ইনুওরেসিস এর প্রধান উপসর্গগুলো হলো

  • ঘুমের মধ্যে মূত্রত্যাগ করা।
  • মূত্রনালিতে জ্বালা এবং প্রদাহ।
  • মূত্রের রং গোলাপি বা লালচে হয়ে যাওয়া।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য অনুভব করা।

রোগনির্ণয়

শিশুর ঘুমের মধ্যে মূত্রত্যাগ করার কারণগুলো মাথায় রেখে সে অনুযায়ী বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেশিশুর ইনুওরেসিস অাছে কিনা, সেটি নির্ণয় করা হয়ে থাকে। যেমন

  • মূত্র পরীক্ষা
  • রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা।
  • কিডনির কার্যকারিতা ও গঠনজনিত সমস্যা নিরূপণে কিছু বিশেষ পরীক্ষা
  • আলট্রাসনোগ্রাম

চিকিৎসা

ইনুওরেসিস অাছে কিনা, সেটি নির্ণয়ের পর শিশুর এই অসুখের প্রতি অভিভাবকের মনোভাব কী, সেটি জানা অত্যন্ত জরুরী। পাশাপাশি পরীক্ষায় কোনো শারীরিক কারণ পাওয়া গেলে সেটিরও যথাযথ চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।

এলার্ম মেথড (Alarm Method)

প্রায় ৭০%-৮০% ক্ষেত্রেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যায়। এতে এক ধরনের বেল বা ছোট ব্যাটারি সংযুক্ত যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। মূত্র বিছানায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এটি বেজে ওঠে এবং অভিভাবকদের সতর্ক করে দেয়।

অ্যালার্ম মেথড

রিওয়ার্ড মেথড (Reward Method)

এই পদ্ধতিতে শিশু সপ্তাহে কোন কোন রাতে বিছানায় মূত্রত্যাগ করেনি সেদিনগুলোকে সবুজ কালি দিয়ে ক্যালেন্ডারে চিহ্নিত করতে হবে। সেই দিনগুলোতে বিছানায় মূত্রত্যাগ না করার জন্য তাকে বিভিন্ন ধরনের পছন্দনীয় পুরস্কার দিতে হবে। কিন্তু যেদিন সে বিছানায় মূত্রত্যাগ করবে, ঐ দিনের জন্য তাকে কোনো পুরস্কার দেয়া যাবে না।

ওষুধ (Medication)

বিষণ্ণতার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় এমন ওষুধ যেমন ইমিপ্রামিন খাওয়ানো যেতে পারে। রাতে ঘুমানোর অাগে স্বল্প মাত্রায় সেবন করলে সুফল পাওয়া যায়।

করণীয়

চিকিৎসকদের করণীয় –

  • মনোযোগ সহকারে রোগীর বিস্তারিত ইতিহাস বিশদভাবে জানা।
  • প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষা (যেমন প্রস্রাব পরীক্ষা) এর ফলাফল সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা।
জানতে হবে রোগের পুরো ইতিহাস
  • অন্যান্য আনুষঙ্গিক শারীরিক ব্যাধির উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা।
  • শিশুর বিছানায় মূত্রত্যাগের পেছনে উল্লেখযোগ্য কোনো পারিপার্শ্বিক নিয়ামক জড়িত আছে কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা।

অভিভাবকের করণীয়

  • বিছানায় ঘুমাতে যাবার আগে শিশুকে পানীয় জাতীয় খাদ্য কম দেয়া। বিশেষ করে চা, কফি ও কোমল পানীয় দেয়া থেকে বিরত থাকা।
  • বিছানায় ঘুমাতে যাবার অাগে শিশুকে উঠিয়ে টয়লেটে নিয়ে মূত্রত্যাগ করিয়ে অানা।
শিশুকে কোনো অবস্থাতেই বকাঝকা করা যাবে না
  • মূত্রত্যাগের জন্য শিশুকে দায়ী করা বা শাস্তি দেয়া থেকে বিরত থাকা।
  • মূত্রত্যাগের ব্যাপারটিকে শিশুর কাছে মুখ্য করে তোলা থেকে বিরত থাকা।

অভিভাবক এবং চিকিৎসকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিশু খুব দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে পারে। কোনো অবস্থাতেই শিশুকে বকা দেয়া যাবে না কিংবা শিশু হীনমন্যতায় ভোগে এমন কথাও বলা যাবে না।

সর্বশেষ - সব খবর