বুধবার , ১৩ নভেম্বর ২০২৪ | ২৯শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

‘ইজতেমার নিয়ন্ত্রণ’ নাকি ‘সাদ কান্দালভি’- তাবলীগ সংকটের কারণ আসলে কী

Paris
নভেম্বর ১৩, ২০২৪ ৮:৫৫ অপরাহ্ণ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :

ঢাকার কাছে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা ও কাকরাইল মসজিদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা তাবলীগ জামাতের দুই অংশ সংঘাতময় পরিস্থিতি এড়াতে ‘আপাতত সংযত’ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত কিছুদিন ধরে তাদের অনড় অবস্থান ও পাল্টাপাল্টি ঘোষণায় সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা করছিলেন অনেকে।

কাকরাইল মসজিদ থেকে ‘সাদপন্থীদের সরিয়ে দেয়া’ এবং ‘তাদের ইজতেমা করতে দেয়া হবে না’ বলে যারা ঘোষণা দিয়েছিলো তারা এখন বলছেন আগের সমঝোতা মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।

এর ফলে কাকরাইল মসজিদ ভাগাভাগি করে ব্যবহার ও দুই পর্বের ইজতেমা আয়োজনে আগের সমঝোতা অব্যাহত থাকবে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন তারা।

ভারতে তাবলীগ-জামাতের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ সাদ কান্দালভির একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক তাবলীগ জামাতের নেতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর থেকে বাংলাদেশে দুই গ্রুপ আলাদা হয়ে দুই পর্বে ইজতেমা আয়োজন করেছেন এবং তাতে অংশ নিচ্ছেন। বিরোধিতার কারণে ২০১৮ সাল থেকে ইজতেমায় আসতে পারছেন না মি. কান্দালভি।

বাংলাদেশের তার অনুসারীদের নেতা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম অবশ্য বলছেন কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ইজতেমায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ইজতেমা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছে। এবারের ইজতেমায় সাদ কান্দালভিকে আনার জন্য সরকারের সহযোগিতা চাইবেন বলেও বিবিসি বাংলাকে জানান তিনি।

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার অভিযোগ সাদ কান্দালভি ‘নবী রাসুলদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য’ করে ইজতেমায় আসার যোগ্যতা হারিয়েছেন।

তাবলীগের মধ্যে সাদবিরোধী অংশের নেতা মাওলানা জুবায়ের আহমেদের ঘনিষ্ঠ মাহফুজ হান্নান বলছেন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে কাকরাইল মসজিদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার কথা বলেছিলেন। “কিন্তু এখন আমাদের সিদ্ধান্ত হলো সরকার বিব্রত হয় এমন কিছু আমরা করবো না। সে কারণে আগের সমঝোতা অনুযায়ী কার্যক্রম চলবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

ওদিকে মাওলানা সাদকে দেশে আনার চেষ্টা করা হলে এবং কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গীর ইজতেমায় তার অনুসারীদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করলে ঢাকা অচল করার হুমকি দেয়া ‘ওলামা মাশায়েখ বাংলাদেশ’ এর একজন নেতা শাহরিয়ার মাহমুদ বলছেন সরকারের সাথে আলোচনার প্রেক্ষাপটে আগের সমঝোতা অনুযায়ী চলবেন তারা।

“কথা ঘোরানোর জন্য হেফাজতকে টেনে আনলে চলবে না। সংকটের জন্য দায়ী সাদ কান্দালভি। তাবলীগের চলমান সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময় দিবো আমরা,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

সংঘাতের আশঙ্কা কিন্তু সংকট এখনো কেন
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবারেও দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। ৩১শে জানুয়ারি প্রথম পর্ব এবং সাতই ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শুরু হবে। ১৯৬৭ সাল থেকে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বিশ্ব ইজতেমা। দেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নেন।

কিন্তু এর মধ্যে গত পাঁচই নভেম্বর সাদবিরোধী ওলামা মাশায়াখরা ঢাকায় সমাবেশ করে সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ সহ নয় দফা দাবি জানায়। এই সমাবেশের আগে তাবলীগের দুই গ্রুপই পাল্টাপাল্টি সমাবেশের ডাক দিলে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে প্রশাসনের মধ্যস্থতায় সাদপন্থীরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন।

পরে সমাবেশে সাদবিরোধীরা দুটির বদলে একটি ইজতেমা, সেই ইজতেমায় সাদ কান্দালভিকে আসতে না দেয়া এবং কাকরাইল মসজিদে সাদপন্থীদের কোনো কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না- বলে ঘোষণা দেয়। জবাবে সাদপন্থীরাও তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।

সেই সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের নেতা শাহ মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী মোনাজাত পরিচালনা করেছেন।

তাবলীগে সাদপন্থীদের নেতা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন তাবলীগের পুরো বিতর্কের মূলেই হলো হেফাজতে ইসলাম। “তারা তাবলীগের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ চায়। সেজন্য এই সংকট তৈরি করেছে। সাদ কান্দালভির অসংখ্য অনুসারী এদেশে। আমরা কোন অন্যায় মানবো না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

এর আগে গত সাত বছর ধরে প্রশাসনের সিদ্ধান্তে কাকরাইল মসজিদে অবস্থানের ক্ষেত্রে সাদবিরোধী অংশটি যারা জুবায়েরপন্থি হিসেবে পরিচিত তারা চার সপ্তাহ ও সাদপন্থিরা দুই সপ্তাহ করে পর্যায়ক্রমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন।

সেই অনুযায়ী এখন কাকরাইল মসজিদ জুবায়েরপন্থীরা অবস্থান করছে। অন্যদিকে শুক্রবার সাদপন্থীদের মসজিদে যাওয়ার কথা। উভয় পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে কাকরাইলে মসজিদে অবস্থানকে কেন্দ্র করে শুক্রবার সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিলো।

এমন প্রেক্ষাপটে সোমবার স্বরাষ্ট্র ও ধর্ম উপদেষ্টা সাদবিরোধী সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শাহরিয়ার মাহমুদ।

“কোন জটিলতা যেন তৈরি না হয় সেজন্য এখন যারা আছেন তারা শুক্রবার সকালেই কাকরাইল মসজিদ ছেড়ে যাবেন। তবে আমরা এপ্রিল মাসের মধ্যে তাবলীগ সংকটের স্থায়ী সমাধান চেয়েছি। এখানে মূল সমস্যা হলো সাদ কান্দালভি। হেফাজতের কথা বলে লাভ নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

সাদবিরোধী এবং জুবায়েরপন্থী অংশের মাহফুজ হান্নান জানিয়েছেন তারা শুক্রবার সকাল আটটার আগেই কাকরাইল ছেড়ে আগের নিয়মে টঙ্গীতে চলে যাবেন।

“তাবলীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ আমরা। আমরা কেন কাকরাইল পাবো না। সে জন্য আমরা দাবি করেছি। তবে সরকারকে বিব্রত করতে চাই না। সেজন্য সে অবস্থান থেকে সরে এসেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

সাদ কান্দালভিকে ঘিরেই সংকট?
মোহাম্মদ সাদ কান্দালভির একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক তাবলীগ জামাতের নেতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর থেকে বাংলাদেশে দুই গ্রুপ আলাদা হয়ে দুই পর্বে ইজতেমা আয়োজন করেছেন এবং তাতে অংশ নিচ্ছেন।

এই তাবলীগ জামাতের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্য রূপ পায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে, যখন ঢাকায় তাদের মূল কেন্দ্র কাকরাইলে দুই দল কর্মীর মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরের বছর কাকরাইল মসজিদের দখল নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছিলো দু’পক্ষের মধ্যে।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে তাবলীগ জামাতের সাদ বিরোধী অংশকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন দিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন নেতা প্রয়াত আহমদ শফী, যিনি মাওলানা শফী নামে পরিচিত ছিলেন।

শাহরিয়ার মাহমুদ বলছেন সাদ কান্দালভির কিছু বিতর্কিত বক্তব্যই আলেম ওলামাদের ক্ষুব্ধ করেছে। এগুলো প্রত্যাহার করে তওবা না চাইলে তাকে এখনো বাংলাদেশে গ্রহণ করা হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

“তারা এখন হেফাজতের কথা বলছে। কিন্তু পাকিস্তানে তো হেফাজত নেই। সেখানে কেন সাদ কান্দালভি যেতে পারেন না। তাকে ভুল স্বীকার করতে হবে। তওবা করতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

সাদ অনুসারী অংশের নেতা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম বলছেন সাদ কান্দালভি কোন বিতর্কিত মন্তব্য করেননি। তিনি যৌক্তিক কথা বলেছেন এবং ধর্ম নিয়ে যেন ব্যবসা না হয় সেটি বলেছেন।

“তৃতীয় পক্ষ এখানে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তাবলীগ জামাত নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তারা। আমাদের বাধা দিলে আমরা সরকারের সাহায্য চাইবো। সহিংসতা আমরা চাই না। কিন্তু আমাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। অসংখ্য অনুসারী আমাদের। তাদের আটকে রাখা যাবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

তিনি বলেন এবারের ইজতেমায় যেন সাদ কান্দালভি আসতে পারেন সেজন্য সরকারের অনুমতি চাইবেন তারা।

হেফাজতে ইসলামির যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলছেন এখানে নিয়ন্ত্রণের কোন প্রশ্নই নেই।

“সমস্যা হলো সাদ কান্দালভি। তিনি নবী রাসুল নিয়ে বিতর্কিত কথা বলেছেন বলেই তাকে মেনে নেয়া হবে না”।

সাদ কান্দালভির কোন বক্তব্য নিয়ে বিভক্তি?
মি. কান্দালভি তাবলীগ জামাতে কিছু সংস্কারের প্রয়োজনের কথা বলে আসছিলেন আগে থেকেই। এ নিয়ে ২০১৭ সালেই ভারতে তাবলীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিভক্তির সূত্রপাত হয়।

তার একটি বক্তব্য ছিল যে “ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়”। অনেকেই মনে করেন যে এই বক্তব্যের মাধ্যমে মিলাদ বা ওয়াজ মাহফিলের মতো কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিনিময়ে অর্থ নেয়ার বিপক্ষে বলা হয়েছে।

সাদ কান্দালভি ওই সময়ে আরও বলেছিলেন, “মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকদের মাদ্রাসার ভেতরে নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত, যাতে মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়ে।”

এসব বক্তব্যে দারুল উলুম দেওবন্দ অনুসারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি করে এবং তাদের বক্তব্য যে মি. কান্দালভির কথাবার্তা আহলে সুন্নাত ওয়া’ল জামাতের বিশ্বাস ও আকিদার বাইরে।

যদিও সাদ বিরোধীরা বলছেন তাদের বিরোধিতার মূল কারণ হলো সাদ কান্দালভি নবী রাসুল নিয়ে বিভিন্ন সময় বিতর্কিত বক্তব্য রেখেছেন।

যদিও বাংলাদেশে এটাও অনেকে মনে করেন যে “ধর্ম শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ না নেয়া এবং মিলাদ মাহফিল বা ওয়াজের জন্য টাকা গ্রহণ’ না করার কথা বলে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক আলেমদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছেন।

কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজত ইসলামের অন্যতম নেতা আজিজুল হক ইসলামাবাদী এ দাবিকে ‘সর্বৈব অসত্য ও বানোয়াট’ বলে উল্লেখ করেছেন।

সূত্র: বিবিসি বাংলা