আহমদিয়া শিশুর লাশ কবর থেকে তুলে ফেলে দেবার ঘটনায় চাঞ্চল্য

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক নবজাতকের লাশ কবর থেকে তুলে রাস্তায় ফেলে রাখার ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। স্বজনদের অভিযোগ, “শিশুটির পরিবার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের হওয়াতেই এমন অমানবিক কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। “

এ ঘটনায় পুলিশ বা শিশুটির পরিবারের পক্ষ থেকে কোন মামলা দায়ের হয়নি।

পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন মূলত: একে দুটি সম্প্রদায়ের বিচ্ছিন্ন কোন্দল হিসেবে বিবেচনা করছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদর উপজেলার ঘাটুরা গ্রামের বাসিন্দা স্বপ্না বেগম গত মঙ্গলবার একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।

নির্ধারিত সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ শিশুটি বৃহস্পতিবার ভোরে মারা গেলে সেখানকার সরকারি একটি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

এর কিছুক্ষণ পরেই স্বপ্না বেগম জানতে পারেন স্থানীয় ধর্মীয় নেতারা মাইকিং করে লোক জড়ো করে, তার সন্তানের লাশ কবর থেকে তুলে রাস্তায় ফেলে রেখেছে।

‘শুধুমাত্র আহমদিয়া সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণেই এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে” বলে অভিযোগ স্বপ্না বেগমের।

বিবিসির সঙ্গে কথা বলার এ পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মৃত নবজাতকের মা।

“সরকারি কবরস্থানে সব মুসলমানই তো কবর দিতে পারবে। আজকে তিনদিনের বাচ্চা, ওর কোন অপরাধ নেই, দুনিয়ার কিছুই বোঝে না। তার লাশ ওরা ফেলে দিসে।”

“পুলিশ, মেম্বার, ডিসি, চেয়ারম্যান তাদের কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়নি, একটু সান্ত্বনা দিতে আসেনি। বলে নাই যে, যা হয়েছে এটা ন্যক্কারজনক ঘটনা, এটা পাপ।”

স্থানীয় প্রশাসন ও ধর্মীয় নেতাদের ব্যাখ্যা

পরে পুলিশি পাহারায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের কান্দিপাড়ায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব কবরস্থানে শিশুটিকে দাফন করা হয়।

লাশ তুলে ফেলার ঘটনা জানতে পেরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এলেও তারা কারও বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের ওসি মো. সেলিম উদ্দিন পুরো বিষয়টিকে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ থেকে সৃষ্ট একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করছেন।

তিনি বলেন, “এটা তো ধর্মীয় বিষয়, দুইটা সম্প্রদায়ের নিজস্ব বিষয়। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের তো নিজের আলাদা কবরস্থান আছে। ওনারা কেন অন্যখানে দাফন করতে গেলেন।”

“ঘটনা নিয়ে আমরা এলাকাবাসীকে দেখি জিজ্ঞাস করবো। তারপর দেখবো কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় কি না।”

লাশ কবর থেকে তোলার ঘটনায় এক পক্ষের ‘সাফাই’

এদিকে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম আখ্যা দিয়ে এই লাশ তুলে ফেলার ঘটনাকে বিধিসম্মত বলে দাবি করছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইসলামি ঐক্যজোটের সেক্রেটারি মোহাম্মদ এনামুল হক।

শিশুটির পরিবার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তিনি ধারণা করছেন।

‘আহমদিয়া শিশুর পরিবার অনেক অন্যায় করেছে। তারা জানতো এখানে কবর দিলে দাঙ্গা হাঙ্গামা হবে। অবশ্যই তাদের ভেতরগত ষড়যন্ত্র ছিল। মুসলমানদের কবরে অমুসলিমদের দাফন হলে সেটা তুলে ফেলার বিধিবিধান আছে। যেহেতু তারা অমুসলিম – এজন্য স্থানীয়রা ওই বাচ্চার লাশ কবর থেকে তুলেছে।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই বিরোধ এতো প্রকট কেন

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে বিভিন্ন জেলায় হামলা ও সামাজিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা।

হেফাজতে ইসলামসহ সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী বেশ কিছু সংগঠন শুরু থেকেই দাবি জানিয়ে আসছে পাকিস্তান যেভাবে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে, সাংবিধানিকভাবে অমুসলিম ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশেও যেন সেটা করা হয়।

এই সংগঠনগুলো জোটবদ্ধ হয়ে ঢাকা, রাজশাহী, শেরপুর, নাটোর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা,টাঙ্গাইল, পঞ্চগড়, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের চালিয়েছে বলে খবর প্রকাশ হয়েছে।

তবে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার খবর পাওয়া যায় ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলায়।

সবশেষ চলতি বছরের জানুয়ারীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কান্দিপাড়া এলাকায় আহমদীয়া জামাতের বার্ষিক জলসা চলার সময় তাদের একটি মসজিদে এবং আশেপাশের বাড়িঘরে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল।

এ ধরণের একের পর এক সংঘর্ষের কারণে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা শহরের মূল সমাজ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রচুর কওমি মাদ্রাসা থাকায় এবং হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক শক্তি বেশি হওয়ায় সেখানে এই বিরোধ প্রকট বলে মনে করছেন আহমদিয়া মুসলিম জামাত বাংলাদেশের মুখপাত্র আহমেদ তবশির চৌধুরী।

তিনি বলেন, “আহমদিয়া পাড়ায় থাকা মানুষদের এখনও হুমকি ধমকি দেয়া হয় কটু কথা শোনানো হয়। ইসলামি দলগুলোর ভেতরে যতোই দ্বন্দ্ব থাকুক। আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে তারা সবাই এক। ইসলামের নাম ভাঙিয়ে এই গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন সময় ভাঙচুর, লুটপাট, হামলা চালিয়েছে, আহমদিয়া মসজিদ দখল করেছে।”

সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে সরকার

বাংলাদেশে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসলেও সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করায় সংখ্যালঘুরা বার বার নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে বলে অভিযোগ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন।

এ ব্যাপারে স্থায়ী সমাধানে না গেলে ভবিষ্যতে বড় ধরণের কোন্দল ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে বলেও তিনি উদ্বেগ জানান।

“ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে অমানবিক ঘটনা ঘটেছে সেখানে প্রশাসনও যথাযথ ভূমিকা নেয়নি। কারণ সরকার সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলামি দলগুলোকে তার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে। এজন্য সরকার সব সম্প্রদায়কে সমানভাবে দেখতে পারছে না। সরকার যখন নীরব থাকে তখন সবাই ধরে নেয় যে এ ধরণের ঘটনা বার বার ঘটানো যাবে।”

এ ঘটনার জেরে আহমদিয়া মুসলিম জামাত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত সুবিচার নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা