কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক টেলিভিশন গণমাধ্যম আল জাজিরায় গত ১ ফেব্রুয়ারি ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স ম্যান’ শিরোনামে প্রচারিত প্রতিবেদনটি জাতিসংঘকে তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি।
আজ বুধবার বিকালে দলের চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ আহ্বান জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
তিনি বলেন, আল জাজিরার প্রতিবেদনে সরকারপ্রধানের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কতিপয় কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে তথ্য প্রমাণসহ নানান দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারি সব প্রতিবাদ বিবৃতিতে প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগগুলোর সুনির্দিষ্ট জবাব না দিয়ে রাজনৈতিক বুলির আড়ালে অভিযোগগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকেও অপরাধ আড়ালের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিও সরকারের ওইসব বক্তবের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যার দাবি জানিয়েছিল।
আল জাজিরার প্রতিবেদন সম্পর্কে জাতিসংঘের বক্তব্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো এবং তার প্রতিবাদে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবাদ-বিবৃতিকে জাতিসংঘ আমলে নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ সংশ্লিষ্ট যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তদন্ত করার আহ্বানের পাশাপাশি জাতিসংঘ জানিয়েছে যে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট কর্তৃক আল জাজিরার প্রামাণ্যচিত্রে যে ধরনের অত্যন্ত সংবেদনশীল টেলিফোনে আঁড়িপাতা ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের কথা উঠে এসেছে ওই ধরনের কোনো সরঞ্জাম ব্যবহারের বিষয় জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত চুক্তিতে নেই। তাছাড়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের কোনো কন্টিনজেন্টে এ রকম সরঞ্জাম ব্যবহারও করে না। কেবলমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা রক্ষায় ওই ধরনের যন্ত্রপাতি জাতিসংঘ ব্যবহার করে থাকে। এবং তাও কঠোরভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে কেবলমাত্র ইউএন শান্তিরক্ষা গোয়েন্দা নীতির আওতায় জাতিসংঘের ফোর্স কমান্ডারের সরাসরি কর্ত্বত্বে। সরকার হাঙ্গেরি থেকে আঁড়িপাতা যন্ত্রপাতি কেনার কথা ইতোমধ্যেই স্বীকার করেছে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এমন একটি দেশ থেকে এসব সরাঞ্জামাদি আমদানির ক্ষেত্রে অপকৌশল অবলম্বনের অভিযোগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা সরকারি বিবৃতিগুলোতে অনুপস্থিত। অথচ বিষয়টি রাষ্ট্রীয় নীতিমালার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি গুরুতর অভিযোগ।
সরকারের সমালোচনা করে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, মেন্ডেটবিহীন এই অবৈধ সরকার বহু আগেই জনগণ কর্তৃক ঘৃণিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়েও গায়ের জোরে কেবলমাত্র রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করেই ক্ষমতায় টিকে আছে। ফ্যাসিবাদি কায়দায় ক্ষমতা আকড়ে থাকার জন্য গুম-খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি লুণ্ঠন আর সীমাহীন দুর্নীতির এক অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে গোটা দেশকে। দেশে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকায় এই দুশাসনের চিত্র জনসম্মুখে আসছে না। এ প্রেক্ষিতেই আল জাজিরার ওই প্রতিবেদন দেশে-বিদেশে সব মহলকে করে তুলেছে আরও উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত।
বিএনপি নেতা আরও বলেন, ৭টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘকে এ বিষয়ে জাতিসংঘের নিজস্ব পদ্ধতিতে যে তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপি তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করছে এবং জাতিসংঘকে তার নিজস্ব পদ্ধতিতে আল জাজিরার প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগের বিষয়ে দ্রুত তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছে।
ড. মোশাররফ বলেন, একদিকে সরকার আল জাজিরার পুরো প্রতিবেদনকেই মিথ্যা ও বানোয়াট বলে নাকচ করে দিয়েছে; অপরদিকে দায়সারাভাবে জাতিসংঘের কর্তৃক তদন্ত আহ্বানে অনাপত্তি জানিয়ে বলেছে, ‘তদন্ত হতেই পারে, এ ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। সরকারের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে আমরা অবশ্যই তদন্ত করব। তবে তদন্তের জন্য জাতিসংঘ সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অনুরোধ জানায়নি’। আবার অন্যদিকে আল জাজিরার বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সেখানে তথ্যগত ভুল আছে, সেগুলো আমরা তুলে ধরব এবং আমরা মামলা করব। আমরা সেটার জন্য কাজ করছি’। অর্থাৎ আল জাজিরার প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাই না করেই সরকার প্রতিবেদনটিকে ঢালাওভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অথচ সঠিক তথ্যের প্রকাশই হচ্ছে ভুল তথ্যের জবাব। আর অপপ্রচার থেকে ভাবমূর্তি পুনঃরুদ্ধারের উপায়ও হচ্ছে আসল সত্য তুলে ধরা। কিন্তু সরকার প্রতিবেদনের মূল বিষয়বস্তু উহ্য রেখে খণ্ডিত তথ্য অথবা প্রান্তিক বিষয়ের ওপর ভর করে ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’ প্রকাশ করে চলছে। যদিও তথ্যচিত্রটি সম্প্রচারের আগে অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, যা তারা উপেক্ষা করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম এই সদস্য বলেন, সেনাবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা বাহিনী জাতীয় ঐক্যের গর্বিত প্রতীক। প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে তার স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখা দল-মত-নির্বিশেষে আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। গোপনীয়তা লংঘনে আঁড়িপাতার সিগন্যাল সরঞ্জামাদি আমদানির ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নাম ব্যবহারের সরকারি ব্যাখ্যা জাতিসংঘ কর্তৃক বাতিল হওয়ার পর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের বৃহত্তম অংশীদার হিসেবে ওই দায়ীত্বে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতাই এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে বলে আমরা আশংকা করছি। এরূপ আশংকার মধ্যেই জাতীয় ঐক্যের প্রতীক আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী তথা আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলতে পারে তার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা, ভবমূর্তি এবং প্রাসঙ্গিকতা।
সুত্রঃ যুগান্তর