রবিবার , ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৬শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

আলোর পথে রুদ্ধ গণতন্ত্র

Paris
সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪ ১১:৫৩ পূর্বাহ্ণ

 

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস আজ। গণতন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি এবং রাষ্ট্র ও সমাজে গণতন্ত্র চর্চাকে উৎসাহিত করতে ২০০৭ সাল থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক দিবসটি পালন করা হয়। প্রতিবছর ১৫ সেপ্টেম্বর দিবসটি পালন করে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশ। এ বছর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের মূল প্রতিপাদ্য— ‘সুশাসন ও নাগরিক অংশগ্রহণের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করা’।

দেশে গণতন্ত্রের চর্চা দীর্ঘদিন ধরে অনেকটা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর নির্বাচনী ব্যবস্থা অনেকটা ভেঙে পড়ে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর দেশে আবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আবহ তৈরি হয়েছে।

গণতন্ত্র সূচকে বিশ্বের ১৬৭টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৭৫তম। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়েই শুরু হয় বাংলাদেশের পথচলা। এরপর ১৯৭৫ সালে এক অভ্যুত্থানের পর সামরিক শাসক ক্ষমতায় বসে। ১৯৮২ সাল থেকে দেশে স্বৈরশাসন চালু হয়। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। বাংলাদেশে নতুন করে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করে। ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর প্রশ্নের মুখে পড়ে গণতন্ত্র। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয় কতৃর্ত্ববাদী শাসন। সবশেষ গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অবসান ঘটে কর্তৃত্ববাদী সরকারের। অসংখ্য নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে আবার আলোর পথে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা চালু করে। গণতন্ত্র বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। ক্ষমতাসীন সরকার আধিপত্য বজায় রাখতে ২০১১ সালে সংবিধানে থাকা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে। এর মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থমকে যায়। রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষ ওই বিধান পুনর্বহালের দাবি জানায় এবং প্রতিবাদে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন বয়কট করে। এ অবস্থায় ১৫২ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী বছরগুলোতে চলে মূলত একদলীয় শাসন। এতে গণতন্ত্রের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ে। ২০১৪ সালের একটি সাংবিধানিক সংশোধনীতে সংসদ কর্তৃক বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এর ফলে বিচার বিভাগ দলীয় প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। খর্ব হয় বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও।

২০১৬ সালের এক আইনের মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থাগুলোর দেশের বাইরের উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করার সুযোগ সীমিত করা হয়। এই পদক্ষেপ কার্যকরভাবে স্বাধীন সুশীল সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার অস্ত্র হয়ে ওঠে। ২০১৮ সালে পার্লামেন্টে এমন একটি কঠোর আইন পাস করা হয়, যা সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠ স্তব্ধ করেছে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে সীমিত করে। আইনটি চালু হওয়ার পর থেকে কর্তৃপক্ষ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা কিংবা ইন্টারনেটে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মানহানির অভিযোগে ২,৫০০ জনেরও বেশি মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সরকার নির্বিচারে আইনি এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে ফোনে আড়িপাতায় লিপ্ত হয়।

সংবিধানে বর্ণিত সমাবেশ করার মৌলিক অধিকারকে কঠোরভাবে সীমিত করে শেখ হাসিনা সরকার। সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা থেকে বিরত রাখতে বিরোধী দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির নেতাকর্মীরা অযৌক্তিক মামলার সম্মুখীন হন। এ ধরনের পদক্ষেপ শুধু দলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের লক্ষ্য করেই নেওয়া হয় না; পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র সমর্থকরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে যারা শুধু সড়কে নিরাপত্তার দাবি তুলেছিল। ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবেই আওয়ামী লীগ নিজ ক্ষমতা মজবুত করে। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে বেসামরিক প্রশাসনের ওপর দলটির নিয়ন্ত্রণ এতটাই নিরঙ্কুশ ছিল যে দল, সরকার এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না।

সরকারের প্রভাবিত নির্বাচন কমিশন, সরকারপন্থি গোষ্ঠীগুলো দ্বারা বেপরোয়া সহিংসতা এবং বিরোধী কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য ভিত্তিহীন অভিযোগ দায়েরকারী ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের আক্রমণের সময় নীরব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষপাতমূলক ভূমিকার মুখোমুখি হওয়ার কারণে বিরোধীদলীয় জোটের কোনো সুযোগ ছিল না। ক্ষমতাসীন দল এবং তার মিত্ররা সংসদে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। মিডিয়া রিপোর্ট বলছে, ‘ব্যালট বাক্স ভর্তি করা, রাতেই ভোট হয়ে যাওয়া এবং ফলে ব্যাপক কারচুপি (কিছু ক্ষেত্রে, এমনকি মৃত ব্যক্তি ভোট দিয়েছেন এমনটাও রেকর্ড করা হয়েছে) এই ধরনের একতরফা বিজয় নিশ্চিতে সাহায্য করে। ২০১৮ সালের ভোট নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণ আস্থা হারায়, ফলে সব স্থানীয় এবং উপনির্বাচনগুলোয় ভোটারদের উপস্থিতি খুবই কম ছিল। বিরোধী দলবিহীন ২০২৪ সালের নির্বাচনও ছিল ডামি নির্বাচন।

গণতন্ত্র সূচকে গতবারের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১৬৭টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে ৭৫তম। যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রকাশ করা ২০২৩ সালের গণতন্ত্র সূচকে (ডেমোক্রেসি ইনডেক্স) শেখ হাসিনার শাসনকে ‘হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা’ বলে অভিহিত করা হয়। সূচকে প্রতিটি দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থকে চারটি ভাগে ভাগ করে ইআইইউ। সেগুলো হলো পূর্ণ গণতন্ত্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা। নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, সরকারের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিকদের স্বাধীনতা এ পাঁচটি ধাপে প্রাপ্ত নম্বর বা স্কোরের ওপর ভিত্তি করে সূচকে দেশগুলোর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার হালনাগাদ অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়।

ইআইইউ বলছে, সর্বশেষ ২০০৬ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধরন ছিল ‘ত্রুটিপূর্ণ’। এরপর ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গণতন্ত্র টানা ‘হাইব্রিড শাসনব্যবস্থার’ তকমা পেয়ে আসছে। হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা বলতে ইআইইউ এমন এক ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে প্রায়ই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। এ শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলের ওপর সরকারের চাপ থাকে। বিচারব্যবস্থা স্বাধীন নয়। সাংবাদিকদের চাপ দেওয়া ও হয়রানি করা হয়। দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, দুর্বল আইনের শাসন, দুর্বল নাগরিক সমাজ এমন শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইআইইউ বলেছে, বাংলাদেশে নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের শিকার হয়েছে। আর এসব দেশে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকারে পরিবর্তন কিংবা পূর্ণ গণতন্ত্রের সুযোগ নেই।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমীন বেপারী বলেন, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গুরুত্ব না দিয়ে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। তবে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে সূচনা হলো, তাতে আমরা আশাবাদী। বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে যদি কোনো কারণে এই সরকার ব্যর্থ হয় তাহলে পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধসে পড়বে এবং দেশের মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য গণতান্ত্রিক সমাজ প্রয়োজন। যেটা গড়তে হলে একটি অর্থনৈতিক শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে হবে। সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ দিয়ে কখনও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তাই আমি মনে করি এই সরকারের উচিত হবে অর্থনৈতিক সংস্কার আনা, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। তবেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে উঠবে। খুব দ্রুতই এই সরকারকে তা করতে হবে। কেননা অগণতান্ত্রিক উপায়ে খুব বেশিদিন তারা যদি ক্ষমতায় থাকতে চায়, তাহলে জনগণ কিন্তু সেটাকে মেনে নেবে না।

 

 

সর্বশেষ - জাতীয়