‘আলাউদ্দীন আলী আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেন’

২০১৫ সালের জুলাই মাস। ঈদের আগের দিন। রোজ বৃহস্পতিবার। আমি চট্টগ্রাম থেকে পরিবারসহ গ্রামে যাচ্ছি। একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করা হয়েছে। এ ধরনের যাত্রায় যা হয় আর কী—গাড়ির ফ্রন্ট সিট দখল করার একটা ব্যাপার থাকে। আমি এসব ব্যাপারে সতর্ক। সহজেই ফ্রন্ট সিট দখল করে নিলাম। বাচ্চারাও পরাজয় মেনে নিল।

আসলে বাচ্চারা জানে, ফ্রন্ট সিট মানেই ভিআইপি ব্যাপার। পা ছড়িয়ে বসা যায়। চোখের কাছেই থাকে লুকিং গ্লাস। ইচ্ছেমত ছবি তোলা যায়। তবে আমার কাছে এরচেয়েও ক্ষমতাবান তথ্য গোপন আছে। সেটা হলো—ফ্রন্ট সিটে বসলে গাড়ির মিউজিক সিস্টেম কন্ট্রোল করা যায়।

তো, যাত্রা শুরু হলো। সাধারণত প্রতিটি যাত্রার আগে আমি জামা-কাপড়ের মত কিছু গান গুছিয়ে রাখি। একটা প্লেলিস্ট বানাই। সেদিনও একের পর এক গান চলছে। গাইছে মেঘদল, মহীনের ঘোড়াগুলি, লেড জেপলিন। সঙ্গে আর্টসেল, জুনুন, ভূপেন হাজারিকা। এর মধ্যে বেলা গড়াচ্ছে। রোদ উঠছে। মেঘ আসছে। আর আমাদের উপজেলা কাছে চলে আসছে। সবাই মিলে বাড়ি কত দূর ভাবছি।

ঈদযাত্রায় সাধারণত দীর্ঘ যানজটে পড়তে হয়। কিছুদূর এগোতেই যানজটের দেখা পাওয়া গেল। গাড়ির ড্রাইভার তখন হাইওয়ে ছেড়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমরা গ্রামের পর গ্রাম পার হচ্ছি। কখনো কাদামাটি, কখনো ইট-সুরকি। আছে উঁচু-নিচু গর্ত। যেন একটু বান্দরবান, একটু খাগড়াছড়ি। সঙ্গে সাধারণ মানুষের ইত্যাদি-ইত্যাদি কৌতূহল।

বাংলাদেশে প্রতি ঈদে বাড়ি ফেরা ঢেউ দেখা যায়। সেই ঢেউ স্থানীয়রা খুব কৌতূহল নিয়ে দেখে। সেদিনও দেখছিল। কিন্তু এর মধ্যেই একটা ঝামেলা হয়ে গেল। আমি আবহাওয়া সংবাদ টিউন করলাম। সে জানালো, আমার প্লে-লিস্টের গান গ্রামের ভেতর যেতে পারছে না। প্রতিটি চেকপোস্টে সে চেকিং ছাড়াই আটকে যাচ্ছে। তার গলা টিপে দিতে হবে।
আমি গাড়ির ড্রাইভারকে বললাম, ‘আপনার নাম জানা হয়নি’।

—’আমার নাম আলমগীর’।
—’বাদশাহ আলমগীর?’
—’না ভাই। ড্রাইভার আলমগীর’।
—’তো, আলমগীর ভাই, আপনার কাছে গান আছে?’
—’আছে’।
—’ছাড়েন’।

আলমগীর ভাই গান ছাড়লেন। একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো। মিতালী মুখার্জি গেয়ে উঠলেন, হারানো দিনের মত হারিয়ে গেছো তুমি। আমি খুবই সারপ্রাউজড হলাম। সামান্য লজ্জাও লাগল। এতক্ষণ পাশাপাশি থাকার পরেও আমি আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হইনি। অথচ তার প্লেলিস্ট পুরোটাই আলাউদ্দীন আলীর কম্পোজিশনে ভর্তি। একের পর এক এই মহান সুরকারের গান বাজছে।

এরপর বাকিটা পথ বদলে গেল। বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত গাড়ির ভেতরে এসে পড়ল। বাতাসকে মনে হলো বন্ধু ভীষণ। আর আমাদের মাইক্রোবাস যেন এক চিত্রা হরিণ; যার চাকা ক্রমাগত শিখড়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা, সেদিন আলাউদ্দীন আলী নিজেই আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেন। কিন্তু শেষেরও আগে আমরা এমন একটা বাড়ি দেখেছিলাম, যার দরজায় ছিল লোকসঙ্গীত। জানালার পর্দায় ধ্রুপদ।

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ