আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্টের কাছে ভারত কী চায়?

হোয়াইট হাউসে আমেরিকান নাগরিকত্ব প্রদান অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন নতুন নাগরিকত্ব পাওয়া পাঁচ ব্যক্তি। এদের মধ্যে একজন ছিলেন চোখে পড়ার মত: ভারত থেকে যাওয়া একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী। নাম সুধা সুন্দরী নারায়ণ। উজ্জ্বল গোলাপী শাড়ি পরে, হাসিমুখে তিনি গর্বের সাথে তুলে ধরেছেন সদ্য পাওয়া তার নাগরিকত্বের সনদ।

এই নাগরিকত্ব প্রদান অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। বলা হচ্ছে, রিপাবলিকান দলের জাতীয় কনভেনশনে ২৫শে অগাস্ট এই অনুষ্ঠানের সম্প্রচার দেখানো একটা দলীয় চমক দেবার প্রয়াস। কিন্তু ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো গর্বের সাথে এই বিরল ঘটনার খবর দিয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট নিজে একজন ভারতীয়ের হাতে নাগরিকত্ব সনদ তুলে দিয়ে তাকে আমেরিকায় স্বাগত জানিয়েছেন।

আমেরিকার অভিবাসন নীতি ভারত ও ভারতীয়দের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকায় প্রযুক্তি মেধা রফতানিতে ভারতের অতীত রেকর্ড গর্বের। সেদেশে এইচওয়ানবি ভিসায় যারা কাজ করতে যান, তাদের অনেকেরই পরবর্তীতে আমেরিকান নাগরিক হয়ে যাবার সুযোগ থাকে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প সুধান সুন্দরী নারায়ণের হাতে সনদ তুলে দিচ্ছেন
 

খোদ প্রেসিডেন্টের প্রকাশ্যে এই স্বীকৃতি দেয়া ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকানদের যথেষ্ট উদ্দীপ্ত করবে। এবং এই অনুষ্ঠান সম্ভবত আমেরিকার ভারতীয় বংশোদ্ভুত জনগোষ্ঠীর সমর্থনের কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছে, কারণ প্রথাগতভাবে এদের অধিকাংশই অতীতে ডেমোক্রাটদের সমর্থন দিয়ে এসেছে।

প্রেসিডেন্টের এই প্রতীকী ইঙ্গিত নি:সন্দেহে একটা ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করবে এবং বিশেষ করে এমন একটা সময়ে যখন ভারত ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক আগের তুলনায় এখন আরও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ভারতীয় আমেরিকানরা হয়ত বর্তমান প্রেসিডেন্টকে তাদের ভোট দিতে পারেন। কিন্তু তারা মি. ট্রাম্পকে ভোট দিন বা মি. বাইডেনকে ভোট দিন। প্রেসিডেন্ট শেষ পর্যন্ত যিনিই হোন না কেন – ভারতের জন্য তিনি কী করতে পারেন?

চীন ও লাদাখ

পাহাড়ি লাদাখ এলাকা

আমেরিকা লাদাখ প্রশ্নে ভারতকে কীভাবে সহায়তা করতে পারে সে ব্যাপারে আমেরিকা বেশ খোলাখুলি তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেছে। হিমালয়ের দুর্গম এলাকায় বিতর্কিত লাদাখ অঞ্চল নিয়ে ভারত ও চীনের বিরোধ দীর্ঘদিনের।

এবছরের এপ্রিল-মে মাস থেকে ভারত ও চীন দুদেশই ওই এলাকায় প্রায় ৫০,০০০ সেনা মোতায়েন করেছে। সেখানে কোন কোন অংশে দুই বাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে দূরত্ব ২০০ মিটারেরও কম। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের আশংকা, অনিচ্ছাকৃতভাবেও দুই সেনাবাহিনীর তরফেই সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলেই তা একটা বড় আকারের সামরিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে।

জুন মাসে ভারতীয় ও চীনা বাহিনীর মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে একটা অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল এবং পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে সেই উত্তেজনা চলেছে।

আমেরিকা এই দ্বন্দ্বে ভারতকে সাহায্য করার জন্য বারবার প্রস্তাব দিয়েছে।

”এই লড়াইয়ে তাদের (ভারত) আমেরিকাকে মিত্র ও অংশীদার হিসাবে পাশে নেয়া দরকার,” এ মাসের গোড়ায় মন্তব্য করেছেন আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও।

কোন কোন ভারতীয় কূটনীতিক আদতেই এ ব্যাপারে একমত যে, ভারতের আমেরিকাকে পাশে নেয়া প্রয়োজন যাতে চীন যেসব অংশ দখল করে রেখেছে বলে অভিযোগ করা হয় সেগুলো ছেড়ে দেবার জন্য চীনের ওপর চাপ দেয়া যায় এবং সেক্ষেত্রে ভারত আঞ্চলিকভাবে তাদের সমর্থনে প্রতিবেশী অন্যান্য দেশকে পাশে নেবার উদ্যোগও নিতে পারে।

টোকিওতে ''দ্য কোয়াড'' জোটের বৈঠকে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং জাপানের প্রতিনিধিরা
 

ভারত এবং আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে সাথে নিয়ে ”দ্য কোয়াড’ নামে একটি জোট গড়ে তুলেছে। টোকিওতে এই অক্টোবর মাসেই কোয়াডের একটি বৈঠক হয়েছে, যে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে – বিশেষ করে চীন ক্রমশ তার শক্তিমত্তার যেসব প্রকাশ ঘটাচ্ছে তা মোকাবেলার উপায় নিয়ে।

ধারণা করা হচ্ছে আমেরিকা এই জোটকে নেটোর মত একটি জোটে পরিণত করার কথা চিন্তাভাবনা করছে।

সম্পর্ক গভীর হচ্ছে

গত বিশ বছরে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক যেভাবে ক্রমশ আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে তার সাথে এধরনের একটা চিন্তাভাবনা বিকাশ লাভ করা নি:সন্দেহে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ভারত চিরাচরিতভাবে জোট-নিরপেক্ষ দেশ হিসাবে থাকতে পছন্দ করেছে। সেটা শীতল যুদ্ধের পুরো সময়ে, এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলদারিত্বের সময় অবশ্যই ভারতের পররাষ্ট্র নীতি ছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনীতি ভারতের পররাষ্ট্র দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এনেছে।

২০০০ সালে তদানীন্তন ভারতীয় প্রেসিডেন্ট কিচেরিল রামান নারায়াণান (বামে) ও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন করমর্দন করছেন
 

প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন ২০০০ সালে এক ঐতিহাসিক সফরে ভারতে যান। প্রায় ২৫ বছরের মধ্যে সেটাই ছিল কোন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের প্রথম ভারত সফর। সেসময় তিনি ভারতকে আমেরিকার মিত্র দেশ হিসাবে পাশে পাবার প্রয়াস নিয়েছিলেন। তার ছয়দিনের ভারত সফর ছিল ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা যুগসন্ধিক্ষণ। এর আগে পর্যন্ত এই দুটি দেশের সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা হতো ‘বিচ্ছিন্ন গণতন্ত্র’ বলে।

এরপর জর্জ ডাব্লিউ বুশ ভারত সফরের সময় যখন একটা পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়, তখন দুই দেশের সম্পর্ক কৌশলগত দিক দিয়ে একটা গভীরতা পায় এবং প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দু’বার ভারত সফর করেন।

এবছর ২৫শে ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গুজরাতে ভর্তি এক স্টেডিয়ামে বিশাল এক জন সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। মি. ট্রাম্পের সম্মানে ওই সমাবেশের উদ্যোক্তা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানে মি. ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ”এটা (দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক) এর আগে কখনও এখনকার মত ভাল ছিল না”।

কিন্তু ভারতকে আমেরিকা সহযোগিতার প্রস্তাব দিলেও, ভারত তা গ্রহণ করতে অনাগ্রহী বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।

অনাগ্রহ

ভারতের এই দ্বিধার অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে।

লন্ডনে ওয়েস্টমিনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. নিতাশা কওলের মনে আমেরিকার প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

”আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির যখন একটা পরস্পরবিরোধী অভিমুখ তৈরি হয়েছে এবং ট্রাম্প বৈশ্বিক পর্যায়ে আমেরিকার প্রতিশ্রুতির মাত্রা কমিয়ে দিচ্ছেন, তখন ট্রাম্প প্রশাসনের এধরনের মৌখিক প্রতিশ্রুতির খুব একটা মূল্য নেই,” তিনি বিবিসিকে বলেন।

”চীন যেখানে মধ্যস্থতার ঘোর বিরোধী এবং ভারতের যেখানে একটা ঈষদুষ্ণ মনোভাব, সেখানে আমেরিকার সহায়তা ও মধ্যস্থতার প্রস্তাব খুব যে একটা বড় পুরস্কার তা কিন্তু নয়।”

শি জিনপিং, নরেন্দ্র মোদী ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি
 

ড. কওল বলছেন, আমেরিকার সাহায্যের প্রস্তাব যদি আন্তরিকও হয়, তাহলেও লাদাখ সমস্যা সমাধানে আমেরিকা ঠিক কীভাবে সহায়তা করতে পারে তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন।

“আমেরিকা সামরিক গোয়েন্দা তৎপরতার মত বিষয়ে অংশ নিতে পারে, যেটা অবশ্য সীমিত পরিসরে হবে – হয়ত হার্ডওয়্যার অর্থাৎ যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষণের মত বিষয়ে তারা সাহায্য দিতে পারবে। এছাড়া ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা প্রশমন করতে আমেরিকা চীনের উদ্দেশ্যে প্রতীকী বার্তা পাঠাচ্ছে,” বলছিলেন তিনি।

আমেরিকার সহায়তা আন্তরিক এবং গুরুত্বপূর্ণ মাত্রার যদি হয়, তাহলে সেটা ভারতীয় জনগণের সাথে জনসংযোগের ক্ষেত্রে আমেরিকার জন্য লাভজনক হবে।

কয়েক দশক ধরে আমেরিকা পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। ফলে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন অংশ আমেরিকাকে নির্ভরযোগ্য বন্ধু হিসাবে বিবেচনা করতে চায় না।

সুইডেনের উপসালা ইউনিভার্সিটির পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট বিভাগের অধ্যাপক অশোক সোয়েইন বলছেন আমেরিকাকে আস্থাভাজন বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে ভারতের সতর্ক থাকা উচিত। তার যুক্তি: “আমেরিকার কখনও কোন দেশের সাথে আস্থাভাজন মিত্রের সম্পর্ক ছিল না এবং মি. ট্রাম্পের শাসনামলে সেটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। চীনের মত শক্তিশালী একটা দেশের সাথে দেনদরবারের ক্ষেত্রে ভারতের জন্য আমেরিকান কার্ড দেখানোটা কাজে দেবে না।”

দুই দলের সমর্থন

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদী করমর্দন করছেন
 

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দুজনেই প্রতীকী সম্পর্কে গভীরভাবে বিশ্বাসী। এবং দুজনের মধ্যে একটা ব্যক্তিগত রসায়ন কাজ করে। কিন্তু কূটনীতিকদের প্রশ্ন হল তাদের এই সম্পর্ক জোরদার করতে আসলে কতটুকু কী করা হয়েছে।

“প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনামলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে দারুণ একটা ব্যক্তিগত রসায়ন কাজ করে। কিন্তু সেটার ওপর ভিত্তি করে এগোনর গতিটা ধীর এবং আমরা দেখতে চাই এটা আরও গতিশীল হোক,” বিবিসিকে বলেছেন সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক নিলাম দেও, যিনি আমেরিকায় দুই মেয়াদে কূটনীতিক হিসাবে কাজ করেছেন।

ভারত আমেরিকার সহায়তা ও মধ্যস্থতার প্রস্তাব গ্রহণও করেনি, প্রত্যাখানও করেনি। অধ্যাপক সোয়েইন বলছেন, ৩রা নভেম্বরের নির্বাচনে কী হয় সেটা দেখার জন্য ভারত অপেক্ষা করতে চায়। কিন্তু কূটনীতিকরা মনে করছেন, খুব বেশি কিছু পরিবর্তন হবে, এমনকী হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব নতুন কারও হাতে গেলেও খুব কিছু বদলাবে না।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার ডেমোক্রাটিক প্রতিপক্ষ জো বাইডেন প্রায় প্রতিটি ইস্যুতে ভিন্নমত পোষণ করেন। এখানে সম্ভবত ব্যতিক্রম হলো ভারত নিয়ে তাদের নীতি। ভারতের সাবেক কূটনীতিকরা বলছেন আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতিতে দুটি প্রধান দলেরই সমর্থন রয়েছে ভারত বিষয়ে।

নিলাম দেও বলছেন, “আমেরিকায় রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রাট – দুই প্রধান পার্টির ভারত নীতি যে এক – এটা এই প্রথম নয়। প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের সময় থেকে সব আমেরিকান প্রেসিডেন্টই ভারত সফর করেছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা ভারতে গেছেন দু্’বার। কাজেই যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, সেই দলের প্রেসিডেন্টের অধীনেই ভারতের সাথে আমেরিকার সম্পর্কে উন্নতি হয়েছে। “

ফলে যে দলের প্রার্থীই হোয়াইট হাউসের দৌড়ে বিজয়ী হন না কেন, এটা মনে হচ্ছে যে, এমনকী নির্বাচনের পরেও চীনের সাথে ভারতের অচলাবস্থা নিরসনে আমেরিকা ভারতের প্রতি তার সহায়তা অব্যাহত রাখবে। তবে ভারত কীভাবে এর জবাব দেবে তা এখনও পুরোই অনিশ্চিত।

 

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা