পৃথিবীতে প্রতিদিন কোটি কোটি টন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এগুলো পরিবেশের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি এসব ময়লা-আবর্জনা সংরক্ষণ বা ধ্বংস করাও মারাত্মক ব্যয়বহুল। বিশ্বের অনেক দেশই বর্জ্য সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এরপরও আমরা এগুলো আগ্নেয়গিরিতে ঢেলে পুড়িয়ে ফেলছি না কেন?
সম্প্রতি এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার গবেষক এমিলি জনসন। আগ্নেয়গিরিতে ফেলে বর্জ্য ধ্বংস না করার পেছনে তার ব্যাখ্যা জেনে নেওয়া যাক-
এটি সত্য যে, আগ্নেয়গিরির লাভায় ফেললে কিছু বর্জ্য পুড়ে নিশ্চিহ্ন হবে। ২০১৮ সালে হাওয়াইয়ের কিলুয়া আগ্নেয়গিরিতে যখন অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়, তখন এটি থেকে বেরোনো লাভার তাপমাত্রা ছিল দুই হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ১ হাজার ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি। এই তাপে অনেক পাথর গলে যায়। বর্জ্য দাহনযন্ত্রেও সাধারণত ১ হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট (১ হাজার থেকে ১২শ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রা থাকে।
তবে সব জায়গার লাভার তাপমাত্রা কিন্তু একই নয়। হাওয়াইয়ের অগ্ন্যুৎপাতে ব্যাসাল্ট নামে এক ধরনের লাভা উৎপন্ন হয়। অন্য আগ্নেয়গিরিতে সৃষ্ট লাভার চেয়ে এই ব্যাসাল্ট অনেক বেশি উত্তপ্ত এবং তরল। যেমন- ওয়াশিংটনের মাউন্ট সেন্ট হেলেন্সের অগ্ন্যুৎপাতে তৈরি হয় তুলনামূলক ঘন ডেসাইট লাভা। মাউন্ট সেন্ট হেলেন্সে ২০০৪ থেকে ২০০৮ সালের অগ্ন্যুৎপাতে একটি লাভা গম্বুজ তৈরি হয়েছিল, যার পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ছিল ১ হাজার ৩০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৭০৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও কম।
তাপামাত্রা ছাড়াও আগ্নেয়গিরিতে বর্জ্য না ফেলার আরও ভালো কারণ রয়েছে। প্রথমত, যদিও দুই হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইটের লাভা আমাদের আবর্জনার অনেক উপকরণ গলিয়ে দিতে পারে; যেমন- খাবারের উচ্ছিষ্ট, কাগজ, প্লাস্টিক, কাচ, এমনকি কিছু ধাতুও। তবে এটি ইস্পাত, নিকেল, লোহার মতো উপাদানগুলো গলানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
দ্বিতীয়ত, পৃথিবীতে সব আগ্নেয়গিরিতে লাভা হ্রদ বা লাভাপূর্ণ বাটির মতো গর্ত নেই, যেখানে আবর্জনা ফেলা যেতে পারে। পৃথিবীতে হাজার হাজার আগ্নেয়গিরির মধ্যে মাত্র আটটিতে সক্রিয় লাভা হ্রদ থাকার খবর জানেন বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে কিলুয়া, অ্যান্টার্কটিকার মাউন্ট ইরেবাস এবং কঙ্গোর নাইরাগঙ্গো অন্যতম। বেশিরভাগ সক্রিয় আগ্নেয়গিরির গর্তই শিলা ও শীতল লাভা দিয়ে ভরা, যেমন- মাউন্ট সেন্ট হেলেন্স অথবা পানি দিয়ে ভরা ওরেগনের ক্রেটার লেক।
তৃতীয় সমস্যা হলো- এই আটটি সক্রিয় লাভা হ্রদে আবর্জনা ফেলা খুবই বিপজ্জনক কাজ। লাভা হ্রদগুলো শীতল লাভার আবরণ দিয়ে ঢাকা। সেই আবরণের ঠিক নিচে রয়েছে তীব্র উত্তপ্ত ও গলিত লাভা। এ অবস্থায় শিলা বা অন্য কোনো বস্তু লাভা হ্রদের পৃষ্ঠভাগের ওপর পড়লে তা ভেঙ্গে যেতে পারে এবং বিশাল বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
২০১৫ সালে কিলুয়ায় ঠিক এমনটিই ঘটেছিল। সেসময় এর পৃষ্ঠভাগ থেকে কয়েকটি পাথরের খণ্ড লাভা হ্রদে পড়ে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটায়, যা গর্ত থেকে শিলা ও লাভা বের করে দেয়। অর্থাৎ, কেউ লাভা হ্রদে বর্জ্য ফেলতে গেলে তাকে জ্বলন্ত আবর্জনা ও লাভা থেকে বাঁচতে দ্রুত পালাতে হবে।
এরপরও ধরে নিলাম, লাভা হ্রদে নিরাপদে বর্জ্য ফেলা সম্ভব, তারপর ওই আবর্জনা থেকে কী হবে? প্লাস্টিক, আবর্জনা, ধাতু পোড়ালে প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। আগ্নেয়গিরি এমনিতেই টনের পর টন সালফার, ক্লোরিন, কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করছে।
সালফার অ্যাসিডিক কুয়াশা তৈরি করে, যাকে ভলকানিক ফগ বা সংক্ষেপে ভগ বলা হয়। এটি আশপাশের এলাকায় মানুষের শ্বাসকষ্ট তৈরি করতে পারে, মেরে ফেলতে পারে গাছপালাও। বিপজ্জনক এসব গ্যাসের সঙ্গে আরও বিষাক্ত গ্যাস মেশানোর ফল কতটা ভয়াবহ হবে, তা ধারণাতীত।
সবশেষ, অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় কাছাকাছি আগ্নেয়গিরিগুলোকে পবিত্র স্থান হিসেবে দেখে। উদাহরণস্বরূপ, কিলুয়ার হালেমা’উমাউ গর্তকে স্থানীয় হাওয়াইয়ানরা অগ্নিদেবী পেলের বাড়ি বলে মনে করে এবং এর চারপাশের এলাকাকে তারা পবিত্র বলে মানে। ফলে, আগ্নেয়গিরিতে বর্জ্য নিক্ষেপ এ ধরনের আদিবাসী সংস্কৃতির জন্য বিশাল অপমানজনক হবে, তা বলাবাহুল্য।
সূত্রঃ জাগো নিউজ