আন্দোলনের মুখে পাঁচ ভিসির বিদায়

আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৩ বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন উপাচার্য (ভিসি) শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছেন। আর স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে মাত্র একজন উপাচার্যকে অপসারণ করা হয়েছে।

এই মুহূর্তে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে। গত ১৩ জানুয়ারি থেকে এই আন্দোলন শুরু হয়।

ভিসির বাসভবনের বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। আমরণ অনশনে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন ১৪ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষক ও শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের আলোচনা হলেও সুরাহা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বলছে, উপাচার্যের বিষয়টি সরকারের এখতিয়ারভুক্ত। সরকারকেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পদত্যাগে বাধ্য হলে ফরিদ উদ্দিন হবেন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আন্দোলনের মুখে সরে যাওয়া ষষ্ঠ উপাচার্য।

এর আগে ২০০৯ সালে পদত্যাগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির পদত্যাগ করেন ২০১২ সালে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেনকে সরে যেতে হয় ২০১৪ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিন আহমেদ ২০১৯ সালে এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম ইমামুল হককেও একই বছর পদত্যাগ করতে হয়।

পদত্যাগ করা ভিসিদের মধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলন শুরু হয়। একজন উপাচার্যকে সরে যেতে হয় সরকার পরিবর্তনের ফলে গড়ে ওঠা আন্দোলনে। বাকি একজন ভিসি কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন।

তবে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন প্রথম মেয়াদ শেষে দ্বিতীয় মেয়াদের এক বছর পার করলে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের কোনো অভিযোগ এখনো ওঠেনি। হলকেন্দ্রিক দাবিতে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সমাধান না করা এবং ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার ঘটনায় তাঁর পদত্যাগের দাবি সামনে চলে আসে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ  বলেন, ‘শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান আন্দোলনের সমাধান করতে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করেছেন। শিক্ষামন্ত্রীর বাসভবনে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় আমরাও উপস্থিত ছিলাম। এখানে ইউজিসির আলাদাভাবে ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। তবে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে অনিয়মের কোনো অভিযোগ নেই। তাই যদি কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে তা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করি। ’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ পদত্যাগ করেন ২০০৯ সালে। ওই বছরের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কয়েক দিন ছাত্র সহিংসতা চলে। ক্যাম্পাসে চলমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব বলয় তৈরির জন্য গণহারে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ ও ছাত্ররাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ উঠেছিল ভিসি শরীফ এনামুল কবিরের বিরুদ্ধে। ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি ছাত্রলীগকর্মীদের হাতেই আরেক ছাত্রলীগকর্মী জোবায়ের নিহত হন। একপর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত আন্দোলনে দায়িত্ব শেষ হওয়ার ৯ মাস আগে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি।

২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল মালেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে মারা যান। সময়মতো অ্যাম্বুল্যান্স না পাওয়ায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেনের বাসায় ও মেডিক্যাল সেন্টারে ব্যাপক ভাঙচুর চালান। এ ঘটনায় উপাচার্য আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জামায়াত-শিবিরের কাতারে ফেলেন। ওই সব ঘটনায় ৯ মাসব্যাপী আন্দোলনে ভেঙে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম। ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।

২০১৯ সালের এপ্রিলে টানা আন্দোলনের মুখে বিদায় নিয়েছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম ইমামুল হক। তিনি শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ বলে গালি দেওয়ায় তাঁর পদত্যাগের দাবি উঠেছিল। একপর্যায়ে অচল হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মেরও অভিযোগ ছিল।

ওই বছরের ১১ এপ্রিল থেকে ১৫ দিনের ছুটিতে যান ইমামুল হক। ২৯ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১১ এপ্রিল থেকে ২৬ মে পর্যন্ত মোট ৪৬ দিনের ছুটি মঞ্জুর করে তাঁর। উপাচার্য হিসেবে তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২৭ মে।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষার্থীদের টানা ১২ দিনের আন্দোলনের মুখে ৩০ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি খোন্দকার নাসির উদ্দিন আহমেদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করার ঘটনায় ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের একপর্যায়ে উপাচার্য নাসিরের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগ আসতে থাকে। ইউজিসির তদন্তেও তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায়।

আর গত ৫০ বছরের মধ্যে শুধু একজন ভিসিকেই অপসারণ করেছিল সরকার। ১৯৯২ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের দাবির মুখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার উপাচার্য আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনকে অপসারণ করে বিএনপি-জামায়াত সরকার। ১৮৯৭ সালের ‘জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট’ অনুসারে এই অপসারণ কার্যকর হয়। গত বছর এই উপাচার্যকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার।

জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম  বলেন, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে চলে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোতে সিনেট ভিসি নিয়োগ দেয়। সেসব ভিসির বিরুদ্ধেও আন্দোলন হয়। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চ্যান্সেলর (রাষ্ট্রপতি) নিয়োগ দেন। তিনি বলেন, অনেক সময় কোনো কোনো উপাচার্য নিয়োগ সঠিক হয় না। আবার উপাচার্যরাও তাঁদের ব্যক্তিগত সমস্যা, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে নিজের নিযুক্তি যে সঠিক ছিল, তা প্রমাণ দিতে পারেন না।

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিক দল দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে—এটাই স্বাভাবিক। তবে এর মানে এই নয় যে যাকে ভিসি করা হবে তিনি পণ্ডিত হবেন না, দক্ষ হবেন না। একজন ভিসিকে একাডেমিক ও প্রশাসনিক দুই দিকেই দক্ষ হতে হয়। আমাদের বেশির ভাগ ভিসিই দক্ষ বলে আমি মনে করি। তবে তাঁদের আচরণে, কথাবার্তায় আরো সাবধান হওয়া উচিত। ’

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ