আট বছর ধরেই গাছের সঙ্গে দুই হাত বাঁধা ১০ বছরের শিশুর!

যে বয়সে বাবা-মার আদর-যত্ন এবং ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বেড়ে ওঠার কথা- ঠিক সে সময়ে সবার অযত্ন অবহেলা এবং মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটছে নীরবের।

এভাবে না রাখা হলে কারও কোনো ক্ষতি করে বসতে পারে সে। মারধর করতে পারে, জিনিসপত্র ভাংচুর করবে অথবা অন্য কোনো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে সে।

নীরবকে নিয়ে তাই মা এবং পরিবারের সবার চরম অশান্তিতে দিন কাটে। আর এ কারণে এভাবেই বন্দি জীবন কাটছে নীরবের। মা নাছরিন বেগম তার এ অসুস্থ সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন সব সময়।

নীরব গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের পূর্ব কাতলামারী গ্রামের নজরুল ইসলামের নাতি। জন্মের পর থেকে নানার বাড়িতেই মায়ের সঙ্গে থাকে নীরব।

২০০৮ সালে কুড়িগ্রামের শরিফুল ইসলামের সঙ্গে নজরুল ইসলামের মেয়ে নাছরিন বেগমের বিয়ে হয়। শরিফুল ইসলাম কখনও ঢাকায় যান আবার কখনও এলাকায় রিকশা চালান। আবার কখনও অন্য কাজ করে সংসার চালান।

বিয়ের প্রথম দুই বছর স্ত্রী নাছরিনকে কুড়িগ্রামের নিজ বাড়িতে নিয়ে রাখেন শরিফুল। পরবর্তীতে নাছরিন বেগম অন্তঃসত্ত্বা হলে তাকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে শরিফুল ঢাকায় চলে যান। সেই থেকে নাছরিন বাবার বাড়িতেই থাকেন।

২০১০ সালের ১ জানুয়ারি নীরবের জন্ম হয়। জন্মের দুই দিনের মাথায় নীরব অসুস্থ হয়ে পড়ে। পায়খানার সঙ্গে রক্ত পড়তে থাকে। প্রথমে তাকে গাইবান্ধা সদর আধুনিক হাসপাতালে এবং পরে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

চিকিৎসায় পায়খানার সাথে রক্ত পড়া বন্ধ হলেও তার পুরোপুরি শারীরিক সুস্থতা ফিরে আসেনি। সেই থেকে নীরবে পড়ে থাকত বিছানায়। তাই বাপ-মা তার নাম রাখে নীরব।

এক বছরেও নীরব দাঁড়াতে পারত না বলে তার কোমরে শক্তি অর্জনের জন্য লোকজনের পরামর্শ বাড়ির উঠানে গর্ত খুঁড়ে তাকে দীর্ঘ সময় সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। যখন সে অস্থিরতা প্রকাশ করত তখন তাকে গর্ত থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হতো।

এভাবে গর্তে ওঠা-নামানোর ঝামেলার কারণে পরে তাকে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে একটা হাত শক্ত করে বেঁধে রাখা হতো। ফলে সে ইচ্ছা করলেই বসতে পারত না। ধীরে ধীরে সে দাঁড়ানো শিখল এবং সাড়ে তিন বছর বয়সে কথা বলতেও শিখল।

কিন্তু ক্রমেই নীরবের মাথায় একটা যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকে। তখন নিজের মাথা যেখানে সেখানে ঠুকতো। এ সময় অন্য ছেলেমেয়েদের ওপর চড়াও হতো এবং মারপিটও করত। তাই বাধ্য হয়ে তাকে দুই গাছের মাঝখানে দুই হাত বেঁধে রাখতে বাধ্য হয় পরিবারের লোকজন।

কারণ এক হাত বেঁধে রাখলে গাছের গায়ে মাথা ঠুকে নিজেকে রক্তাক্ত করে। রাতে ঘুমানোর সময় তার দুই পা বেঁধে রাখা হয়। না হলে সে লাথি দেয়া শুরু করে। সে সারারাত ঘুমায় না। বিছানায় পায়খানা প্রস্রাব করে। এ বয়সে ঘুমের ওষুধ দিয়ে তাকে ঘুমানো হয়।

পরিবারের লোকজন তাকে বিভিন্ন সময়ে শিশু চিকিৎসক এবং মাথার চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের শরণাপন্ন হন। কিন্তু সে সুস্থ হয়ে উঠছে না। বাবা শরিফুল ইসলাম ঢাকা থেকে এসে দুই একদিন থেকে আবার চলে যান। ছেলের চিকিৎসার জন্য টাকা দিয়ে যান। নানাও নাতির চিকিৎসার জন্য অর্থ ব্যয় করেছেন।

এই গরিব পরিবার নীরবের চিকিৎসার জন্য এ পর্যন্ত ৫ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করেছেন। কিন্তু সে সুস্থ হয়নি। পাড়া-প্রতিবেশীদের ধারণা অর্থের অভাবে তার প্রকৃত চিকিৎসা হচ্ছে না।

এ ব্যাপারে নীরবের নানা নজরুল ইসলাম বলেন, নীরবকে প্রতিদিন গাছের সঙ্গে দুই হাত শক্ত করে বেঁধে রাখতে হয়। না হলে সে গাছের সঙ্গে মাথা ঠোকে। এতে বহুবার সে রক্তাক্ত হয়েছে। আমরা গরিব মানুষ। এখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না।

মা নাছরিন বেগম বলেন, বাবা-মা এবং আমাদের সহায়-সম্বল যা ছিল তা বিক্রি করে ওর চিকিৎসা করেছি। কিন্তু আর পারছি না। কষ্ট নিয়েই বলছি ছেলেটা হয়তো বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। সরকার বা কোনো সহৃদয় ব্যক্তি কী ওর চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে পারে না? চিকিৎসা হলে ও হয়তো ভালো হয়ে যাবে। সূত্র: যুগান্তর