অর্থকারি ফসল লাক্ষা: বহুল ব্যবহারেও সঙ্কটে চাষ

শাহিনুল আশিক:


প্রায় ১৫ ধরনের কাজে ব্যবহার হয় লাক্ষা। দেশে প্রতিবছর লাক্ষার চাহিদা প্রায় দশ হাজার মেট্রিকটন। কিন্তু উৎপাদন হয় সর্বোচ্চ ২০০ মেট্রিকটন। যার মধ্যে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে ১৫০ মেট্রিকটন লাক্ষা উৎপাদন হয়। তবে দাম না থাকাসহ নানান কারণে এই অর্থকরি ফসল চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন চাষিরা।



তবে আশার কথা- দেশে যে পরিমাণ বরই গাছ আছে, তা পরিকল্পনা করে লাক্ষা চাষের আওতায় আনা গেলে স্বনির্ভর হয়ে বিদেশে রপ্তানিও করা সম্ভব হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, সাত বছর আগে একটা জরিপ হয়েছিল। সেই জরিপে উঠে এসেছে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জে সে সময় ৭০০ থেকে ৮০০ মেট্রিকটন লাক্ষার চাষ হতো। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলায় বছরে চাষ হয় ১৫০ মেট্রিকটন। একসময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, শিবগঞ্জের বিশাল এলাকাজুড়ে চাষ হতো লাক্ষার। এখন শুধু নাচোলের কাজলাগ্রাম ও মাকতাপুরের পুরোগ্রামে লাক্ষার চাষ হয়।

লাক্ষা এক ধরনের ক্ষুদ্র পোকা। মূলত বড়ই, পলাশ, বাবলা- এ ধরনের পোষক গাছ থেকে লাক্ষা উৎপাদন করা সম্ভব। লাক্ষা প্রক্রিয়াজাত করে কাঠের আসবাবপত্র ও পিতল বার্নিশ করা, স্বর্ণালংকারের ফাঁপা অংশ পূরণ, ওষুধের ক্যাপসুলের কোটিং, চকলেট ও চুইংগামের কোটিং, ডাকঘরের চিঠি বা পার্সেল সিলমোহরের কাজ, লবণাক্ত পানি থেকে জাহাজের তলদেশ রক্ষা বা লবণাক্ততায় নষ্ট হওয়া লৌহ ঠিক করার কাজে, অস্ত্র ও রেল কারখানার কাজে, পুতুল, খেলনা ও টিস্যু পেপার তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়।

নাচোলের লাক্ষা চাষি সাদিকুল ইসলাম বলেন, গাছের ডালে বাকলের মতো লাক্ষা লেগে থাকে। বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে বিক্রি করা হয়। তবে লাক্ষা আগের মতো চাষ হয় না। যে লাক্ষা চাষ হয় সেগুলো বগুড়ায় চাঁচ তৈরির কারখানা এবং বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে সরবরাহ করা হয়।

কলাবোনা এলাকার লাক্ষা চাষি আজিজুল হক বলেন, লাক্ষা চাষে কোনো খরচ নেই। তবে এর বীজ (লাক্ষা পোকা) পাওয়া সমস্যা। তবে সবচেয়ে বরই গাছে ভালো হয় লাক্ষা চাষ। আমরা শুনেছি ভারতে এই লাক্ষার চাহিদা ব্যাপক।

তিনি আরো বলেন, লাক্ষা অর্থকরি ফসল। বিক্রির সমস্যা, দাম না পওয়ার কারণে আগ্রহ হারায় চাষীরা। তবে বর্তমানে চাহিদা ও দাম ভালো। চাহিদার কথা মাথায় রেখে লাক্ষার চাষে সরকারিভাবে সহায়তা চান তারা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই অর্থকরি ফসল চাষে আগ্রহ বাড়বে চাষিদের।

নওগাঁর নিয়ামতপুর রসুলপুরের লাক্ষা ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম জানান, ‘আমার বাবা সফিকুল ইসলাম লাক্ষার ব্যবসা করতেন। তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জে সবচেয়ে বেশি লাক্ষা চাষ হতো। বর্তমানে এক মণ লাক্ষার দাম ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুকনা হলে ২০ হাজার টাকা। আর কাঁচা হলে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা দামে কেনা-বেচা হয়। তবে গত বছর ১৪ হাজার থেকে ২৪ হাজার টাকা মণ দরে লাক্ষা বিক্রি হয়েছে।’

তিনি জানান, ‘তিন বছর আগে নাচোলেও লাক্ষা ছিল না। এরপরে আমরা চাষিদের সাথে আলোচনা করে গোমস্তাপুরের বামনগ্রাম ছাড়াও বিভিন্ন এলাকা থেকে লাক্ষা সংগ্রহ করি। এখন মোটামোটি লাক্ষার চাষ বেড়েছে। প্রায় চার বছর আগে প্রতি সপ্তার বোববার নাচোলে লাক্ষা বিক্রির হাট বসতো। সেই সময় প্রতিহাটে ৮ থেকে ১০ মণ লাক্ষা কেনা-বেচা হতো। এখন আর সেই হাট নেই।’
মনিরুল ইসলাম আরো জানান, ‘নাচোলের বিভিন্ন এলাকা থেকে লাক্ষাগুলো কিনে বগুড়ায় পাঠায়। এখন সপ্তায় দুই থেকে তিনদিনে মোট ১০০ বা ১৩০ কেজি লাক্ষা বগুড়ায় পাঠায়।’

গোদাগাড়ীর কাঁকনহাটের পাকড়ী ইউনিয়নের ইয়াদপুর লাক্ষা চাষী দুরুল হুদু জানান, ‘রোববার (১০ অক্টোবর) ৩৬ কেজি লাক্ষা বিক্রি করেছি। যার দাম লেগেছে ১২ হাজার টাকা। তার ১৫টি বরই গাছে ছিলো লাক্ষা। এখন দুইটি গাছে আছে। অনেকেই লাক্ষা চাষের কথা বলে। তবে প্রশিক্ষণ, লাক্ষার বীজ ও সরকারি সহযোগিতা পেলে বেশি করে লাক্ষা চাষ করবো।’

লাক্ষা চাষে খরচের বিষয়ে তিনি বলেন- লাক্ষা চাষে কোনো খরচ নেই। শুধু বৈশাখ মাসে লাক্ষায় একবার পানি দিতে হয়। এর বাইরে কোনো খরচ নেই।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কেজেএম আব্দুল আউয়াল জানান, রাজশাহীতে লাক্ষার চাষ হয় না। গোদাগাড়ীর বনসুন্দরী বাগানে পরীক্ষামূলক চাষের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। কারণ এখানে মিষ্টি বরই। আর চাষি বরই গাছে কিটনাশক ব্যবহার করে। কিটনাশকের ফলে লাক্ষা পোকা মারা গেছে। তবে দেশি জাতের বরই গাছে লাক্ষা চাষ ভালো হবে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জের লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মোখলেসুর রহমান জানান, শুধু নাচোলের কাজলাগ্রাম ও মাকতাপুরের পুরোগ্রামে এই লাক্ষা চাষ হয়। এই চাষের সঙ্গে প্রায় ৪০০ মানুষ জড়িত। এই অঞ্চলে ১ লাখের বেশি বরই গাছ লাক্ষা চাষে উপযোগী। এই গাছগুলো লাক্ষা চাষ করা গেলে ৫০০ মেট্রিকটনের বেশি লাক্ষা উৎপাদন করা সম্ভব।

তিনি জানান, ছাড়ানো লাক্ষা প্রক্রিয়াজাত করে চাঁচ, টিকিয়া ও গালা তৈরি করা হয় এবং প্রায় একশ কেজি ছাড়ানো লাক্ষা থেকে ৫০ থেকে ৬০ কেজি চাঁচ বা গালা পাওয়া সম্ভব। লাক্ষা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি। প্রক্রিয়াজাত করে দিলে ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্য চাঁপাই-শিবগঞ্জে আমবাগান বেশি। বেশি কীটনাশক ব্যবহার হয়। এতে করে আশে পাশের গাছের লাক্ষা পোকা মারা যায়। তবে এটি সম্ভাবনাময় ফসল। আমরাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি চাষ বৃদ্ধির।

স/আ