ইংল্যান্ডের রাজা জেমসের বিশেষ দূত হয়ে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে এসেছিলেন ইংরেজ কূটনীতিক টমাস রো। উদ্দেশ্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য বাণিজ্য ছাড় আদায়। বছরের পর বছর তিনি সম্রাটের পেছনে ঘুরেছেন, উপহার-উপঢৌকন আর মিষ্টি কথা দিয়ে তার মন জয়ের চেষ্টা করেছেন। সম্রাটের কন্যা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে হেকিম-কবিরাজ যখন রোগ সারাতে ব্যর্থ হলেন তখন টমাস রো ইংরেজ চিকিৎসক গ্যাব্রিয়েল বোটনকে নিয়ে গেলেন, যার চিকিৎসায় সম্রাট-কন্যা সুস্থ হয়ে উঠলেন। সম্রাট খুশি হয়ে পুরস্কার দিতে চাইলে টমাস রো নিজের জন্য কিছু চাননি। তিনি তার স্বজাতির জন্য শুল্কমুক্ত ব্যবসার সুযোগ চেয়েছিলেন। দিল্লিশ্বর সে সুযোগ তাকে দিলেন।
পরবর্তী সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে একচ্ছত্র রাজত্ব করল। বাণিজ্য তো বটেই, পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতাও তাদের পদানত হয়েছিল। ইংরেজ টমাস রো যে ঘটনায় তার অসাধারণ দূরদৃষ্টি এবং বিচক্ষণ কূটনৈতিক কৌশলের পরিচয় দিয়ে তিনশ’ বছর ধরে তার জাতিকে আরেক দেশের সম্পদ-ক্ষমতা ভোগের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, সেই একই ঘটনায় নিজেদের প্রজ্ঞাহীন কূটনৈতিক কৌশলের পরিচয় দিয়ে মুঘলরা জাতির স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির বিনাশ করেছিল। একবিংশ শতকের পৃথিবীতে ভৌগোলিকভাবে দেশ দখলের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কিন্তু কূটনৈতিক আচরণ ও সিদ্ধান্ত সঠিক না হলে দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখেও আন্তর্জাতিক মহলের চাপের নিচেই যে পড়ে থাকতে হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
অধিকন্তু, দশকের পর দশক অন্য দেশের নির্যাতিত মানুষকে মানবতার খাতিরে আশ্রয় দিয়েও সেই আশ্রিতদেরই বিষয়ে কূটনৈতিক দূরদর্শিতাবর্জিত আচরণের ফলে গোটা বিশ্বে নিজেদের অবস্থান হাস্যকর, এমনকি অমানবিক বলে পরিগণিত হতে পারে। যেটি হচ্ছে সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আচরণ ও মন্তব্যকে ঘিরে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের কাছে কোনো জায়গা নেই। যারা বড় মাতবর, যারা আমাদের উপদেশ দেন, আদেশ করেন, তারাও রোহিঙ্গাদের নিতে পারেন। তাদের জায়গার কোনো অভাব নেই। ঠিক একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী, যিনি ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতীয় দূত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কিছু রোহিঙ্গা চায়না নিয়ে নিক না। কথাগুলোর মধ্যে যতটা না কূটনীতিক প্রজ্ঞার ইঙ্গিত আছে, তার চেয়ে বেশি আছে অভিমান, যুক্তিহীনও বটে। আসলে কোনো দেশের মানুষ নির্যাতিত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলে এবং বৈধ বা অবৈধ- যে প্রকারেই হোক, অন্য দেশে ঢুকে গেলে তাদেরকে অন্য রাষ্ট্রগুলো ভাগাভাগি করে নেবে, এমন কোনো নীতি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নেই। আর এটিই হচ্ছে আশ্রয়দাতা রাষ্ট্রের কূটনৈতিক দক্ষতা ও প্রজ্ঞা প্রদর্শনের যথার্থ সুযোগ। ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের প্রশংসা পেয়েছে।
কিন্তু সে কারণে আত্মপ্রসাদ লাভের সুযোগ কখনই ছিল না। কেননা, যতই আর্থিক সহায়তার থলে নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিক বা দাঁড়াক, দিন শেষে এই মানুষগুলোর দায়িত্ব শুধুই বাংলাদেশের। আর্থিক সহায়তা দিতে এসে কে কেমন লাভবান হয়েছেন, সে বিশ্লেষণ থাক। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাদের কোনো আগ্রহ বা জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ যে ছিল না, সে কথা অজানা নেই কারও। কাজেই আর্থিক সহায়তা হোক বা আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের বিপক্ষে রায় প্রদান করা হোক, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কোনোকিছুই বাংলাদেশের কূটনৈতিক কৌশলের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। সম্প্রতি একাধিকবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কণ্ঠে একই সুর ও ধ্বনির উচ্চারণ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করলেও রোহিঙ্গা বিষয়ে তা সুপরিকল্পনা ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার নির্দেশ দেয় না।
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫ নং ধারার দিকে দৃষ্টি দিলেই তা বোঝা যায়। আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতি উন্নয়নের এ ধারাটির প্রতিফলন আমরা কতটুকু দেখতে পাই, যখন ‘রোহিঙ্গাদেরকে আর কেউ নিক’ টাইপের অভিমানমিশ্রিত কথা শুনি? কতটুকু মানবিক দৃষ্টিতে সাগরে ভাসমান ৫০০ রোহিঙ্গার ব্যাপারে মন্তব্যগুলো করা হচ্ছে? ধারা ২৫-এ যে তিনটি অনুষঙ্গ উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, তার কোনটি মানবিকতা বিসর্জন দিয়ে অর্জন সম্ভব? এত বছর ধরে তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার সময় কতটুকু মনে ছিল যে আরও রোহিঙ্গা নেয়ার জন্য এই বাহবা প্রদানকারীরাই এক সময় চাপ সৃষ্টি করবে? বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার বাইরে অবস্থান করা সাগরে ভাসমান মানুষকে বাংলাদেশই নেবে কারণ ইতোপূর্বে একই নৃ-গোষ্ঠীর কয়েক লাখ মানুষকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে- এমন প্রত্যাশা অন্যদের মনে জন্ম দেয়ার মতো ইতোপূর্বেকার আচরণগুলো আমরা কতটুকু মূল্যায়ন করেছি? শেষ প্রশ্নটির উত্তরে একটি উদাহরণ দেয়া যাক।
২০১২ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিকতার প্রকাশ ছিল দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশ কখনও কোনোভাবে অমানবিক আচরণ করেনি এবং করবেও না (১৪ জুন, ২০১২, বিডিনিউজ২৪)। এহেন আশ্বাসের পরের বছরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, আর কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণ করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয় (১৭ আগস্ট, ২০১৩, বিবিসি)। তারপর কত সংখ্যক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে, তা সবার জানা। আর এর যৌক্তিকতা উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে এভাবে : সরকার মানবিক কারণে দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আশ্রয় দিয়েছে (বাংলা ট্রিবিউন, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭)। কিছুদিন পর পর অবস্থান পরিবর্তনের এহেন নীতি আরও রোহিঙ্গা গ্রহণের বিষয়ে বহির্বিশ্বকে আশাবাদী করে বৈকি। সেই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাথায় এ প্রশ্ন চলে আসাও বিচিত্র নয় যে, ভাসানচরে এপ্রিলের শুরুতে প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে পারলে আরও ৫০০ রোহিঙ্গাকে সেখানে আশ্রয় দিতে অসুবিধা কোথায়, যেহেতু সরকারিভাবেই জানানো হয়েছে যে, সেখানে তাদের জন্য সব সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে? এশিয়ার একাধিক দেশে নিয়োজিত অস্ট্রেলিয়ার সাবেক কূটনীতিক জেফ্রি মিলারের মতে, সফল কূটনীতির দুটো অন্যতম প্রধান কৌশল হল দেশের স্বার্থ, অগ্রাধিকার ও নীতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখা এবং সমমর্মিতা। মুঘল আমলে ইংরেজ কূটনীতিক টমাস রো’র আচরণে তার দেশের স্বার্থের ব্যাপারে তার ধারণা যে ভীষণ স্বচ্ছ ছিল, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। সে অনুযায়ীই সে কাজ হাসিল করেছে। দেশের স্বার্থ ও সমমর্মিতার ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়, তা কূটনীতিকরাই ভালো বলতে পারবেন।
তবে, আমাদের সমমর্মিতার পারদ যে বেশ ওঠানামা করে, তা কূটনীতিতে অজ্ঞ ব্যক্তিও বেশ বুঝতে পারে ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন ও অভিমানমাখা কূটনৈতিক আচরণে। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে দিন কাটছে বাংলাদেশের। আজও ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন ও ১৯৬৭ সালের শরণার্থী প্রটোকলে স্বাক্ষর না করার দোহাই দিয়েই চলে যাচ্ছে। অথচ মানবাধিকারবিষয়ক আইসিসিপিআর ১৯৬৬, আইসিইএসসিআর ১৯৬৬, সিডও ১৯৭৯, সিআরসি ১৯৮৯-তে স্বাক্ষরের পরও বাংলাদেশে কেন, কিভাবে, কতটুকু আশ্রয়-সুবিধা-অধিকার শরণার্থীরা পাবে, সে বিষয়ে তৈরি হয়নি দেশীয় নীতিমালা।
তারা তাই জলজ প্রাণীর মতো মাসের পর মাস সাগরে ভাসে, ক্যাম্পের ভেতর গ্যাস সিলিন্ডার থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে সম্মুখীন হয় ক্ষয়ক্ষতির, করোনাভাইরাস শনাক্ত-চিকিৎসা লাভের ক্ষেত্রে থাকে পেছনের সারিতে। ডেসমন্ড টুটু বলেছিলেন, অবিচার-অন্যায়ের মুহূর্তে তুমি যদি নীরব থাকো, তাহলে তুমি অন্যায়কারীর পক্ষই বেছে নিলে। রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের কূটনৈতিক কৌশল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কৌশলের মতো আবেগতাড়িত বা টমাস রো’র কৌশলের মতো চতুর- কোনোটাই না হোক। হোক সমমর্মী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ, যা নিজের দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে কাজ করবে, মানবিকতায়ও দেশকে অগ্রগামী রাখবে।
ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ এবং গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
সুত্রঃ যুগান্তর