অভাব ও যুদ্ধের মাঝেও স্বাধীন জীবনের লড়াইয়ে গাজার নারীরা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

গাজা উপত্যকায় দারিদ্রের কষাঘাত ও বঞ্চনার মধ্য দিয়েও ফিলিস্তিনি নারীরা একটি স্বাভাবিক জীবনের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। ঠিক পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নারীদের মতোই তারা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জীবন গড়তে চাচ্ছেন।

ডিজিটাল বিপণনে কাজ করেন নাদা রাদওয়ান। কিন্তু উপত্যকাটিতে যখন ৫০ শতাংশের কাছাকাছি বেকারত্ব, তখন তার কাজের গতিও কমে গেছে। এবার তিনি নিজের একটি শখের কাজের ওপর প্রযুক্তি দক্ষতা ঢেলে দিতে চাচ্ছেন। সেটি হলো- রান্না-বান্নার কাজ।-খবর রয়টার্সের।

২৭ বছর বয়সী রাদওয়ান বলেন, এখানে একটি চাকরি খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। কাজেই আমি পছন্দ করি, এমন কিছু একটা করার কথা ভাবছি। যাতে একই সঙ্গে আমার উপার্জনও হবে।

এর পর থেকে সামাজিকমাধ্যমে তিনি রান্না শেখার টিউটোরিয়াল পোস্ট করতে থাকেন, যার নাম দিয়েছেন নাদা কিচেন।

রাদওয়ান বলেন, তিনি ইউটিউব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন। এমনকি সৌদি আরবের বেশ কয়েকটি কোম্পানি তার ভিডিও কিনে নিয়েছে।

তিনি বলেন, একটি চাকরি খোঁজার মাধ্যমে গাজার ওপর এক দশকের শারীরিক নিষেধাজ্ঞাকে পরাজিত করতে চাচ্ছি আমি। এ জন্য কিছুটা মেধা, একটি ক্যামেরা ও ইন্টারনেট সংযোগ দরকার।

উপত্যকাটিতে প্রায় ২০ লাখ লোকের বসবাস। ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা লগ্নে এসব লোককে তাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।

ছোট্ট গাজা উপত্যকাটির সঙ্গে ইসরাইল ছাড়াও মিসরেরও সীমান্ত রয়েছে।

প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের আতঙ্কের কথা বলে গাজার স্থল ও সমুদ্রসীমার কঠোর নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইল। এমনকি গাজা সীমান্ত দিয়ে লোকজনের চলাচলেও কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে রেখেছে মিসর।

এতে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে উপত্যকাটি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করার পরও একটি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে এখানকার নারীদের।

নাদা রাদওয়ানের ছোট বোন লামা বলেন, নিজের প্রয়োজন মেটানোর মতো একটি চাকরি জোগানো খুবই কঠিন কাজ।

২২ বছর বয়সী এ তরুণী গণমাধ্যম ও যোগাযোগের ওপর স্নাতক পাস করেছেন। নিজের জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনিও বোনের রান্নার প্রকল্পে যোগ দিয়েছেন।

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

প্রতিকূল পরিস্থিতি

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সঙ্গে আলাপকালে গাজা উপত্যকার নারীরা তাদের ব্যক্তিগত জীবনের লড়াইয়ের কথা বলেছেন। তারা বলেন, ইসরাইলি অবরোধের কারণে তাদের জন্য বিয়ে করা তো দূরের কথা শপিং করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

গত এক দশকে হামাসের সঙ্গে তিনটি যুদ্ধে করেছে ইসরাইল। উপত্যকাটির অষ্টাদশী তরুণী হানা আবু আল রোস বলেন, চলতি গ্রীষ্মে তিনি বিয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি এখানকার কোনো দোকানে পাওয়া যায়নি।

অনেকটা হতাশার সুরে হানা বলেন, এখন পর্যন্ত নিজের বিয়ের পোশাক পছন্দ করতে পারিনি আমি।

হাইস্কুলের চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ব্যস্ত সময় পার করা হানা বলেন, আমি খুবই হতাশ। তবে আমার বোন আমাকে সহায়তা করছেন।

তবে গাজার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধকে পাশ কাটিয়ে চাকরি খুঁজতে গিয়ে সামাজিক চাপেও পড়তে হচ্ছে তাদের। কখনও কখনও দেখা যাচ্ছে, তারা এমন কাজ পাচ্ছেন, যেটি তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে মেলে না।

পরিবার চালাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছেন সারাহ ইয়াজহি। এর পর তিনি বিয়ের পরিকল্পনাকারী হিসেবে একটি কাজ খুঁজে পান। এ কাজের জন্য তাকে গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রতিবেশীরা আমার এ কাজকে মেনে নিতে পারছেন না। আমাকে নিয়ে তারা বিভিন্ন মন্তব্য ছুড়ছেন।

২৮ বছর বয়সী সারাহ বলেন, এসব মন্তব্যের কোনোটাকে আমি খুবই ঘৃণা করি। কিন্তু নিজের কাজকে আমি ভালোবাসি, একসময় নিজের ব্যবসা খোলারও স্বপ্ন দেখি।

গাজায় তিনিই প্রথম নারী পার্টি-প্ল্যানার হতে চান বলে জানিয়েছেন।

গাজায় যেসব নারী কর্মরত, সবসময় তাদের একটি অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। চাকরি হারানোর দুশ্চিন্তা তাদের পিছু ছাড়ছে না।

সারা আবু তাকিয়া নামের এক তরুণী বলেন, গাজার একটি হাসপাতালে তিনি একটি অস্থায়ী কাজ পান। এর আগে ধাত্রীবিদ্যার ওপর তিনি ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন।

তবে তিনি একটি চাকরি পেলেও তার বহু সহপাঠী তার মতো ভাগ্যবতী নন বলে জানালেন সারা।

বছর তেইশের সারা বলেন, আমি ছয় মাসের চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছি। তবে এর পর তিনি কাজে থাকতে পারবেন বলে কোনো নিশ্চয়তা নেই।

গাজার আল আহলি হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে কাজ করছেন সারা আবু তাকিয়া। তিনি বলেন, ভূমধ্যসাগরের জলরাশির মধ্যে তিনি সান্ত্বনা খুঁজে বেড়ান। গাজা উপকূলে এসে আছড়ে পড়ে সাগরের বড় বড় ঢেউ।

তার ভাষ্য, আমরা খুবই ভাগ্যবতী যে আমাদের একটি সমুদ্র আছে। এই সৈকতটি হচ্ছে- আমাদের স্বস্তির জায়গা। অভাব-অনটন আর যুদ্ধের মাঝে এই আছড়েপড়া ঢেউগুলো আমাদের আশ্বাস দিয়ে যায়।