অবৈধ ইটভাটা গিলছে ফসলি জমির টপ সয়েল

রংপুরের পীরগঞ্জে প্রায় অর্ধ শতাধিক অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। এসব ভাটার গর্ভে চলে যাচ্ছে কৃষিজমির টপ সয়েল (উপরিভাগের মাটি)। কয়লার বদলে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। আর ইট তৈরির মৌসুমকে ঘিরে ভাটাগুলোতে মজুদ করা হয়েছে বিশাল আকারের মাটির স্তুপ।

ইতোমধ্যে প্রায় ৩০টি ভাটায় ইট পোড়ানোর লক্ষ্যে আগুন দেওয়া হয়েছে। যার সবগুলোতে দেদারছে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। বিধি অনুযায়ী অটোভাটা করার কথা থাকলেও উপজেলায় এবার আরো দুটি অবৈধ ফিক্সড চিমনির ভাটা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিবছর ভাটাগুলোতে প্রায় ৩০০ একর জমির টপ সয়েল পোড়ানো হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত ১৯৯২ সালের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে ‘কৃষি-জমিতে ইটভাটা নির্মাণ দণ্ডনীয় অপরাধ’। কিন্তু পীরগঞ্জে তা মানা হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পীরগঞ্জে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী মাত্র পাঁচ-ছয়টি ইটের অটোভাটা রয়েছে। ১৫টি ইউনিয়নে ৪৭টি ফিক্সড চিমনির ভাটায় ইট পোড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে অবৈধভাবে কৃষি জমির টপ সয়েল ও জ্বালানি হিসেবে কাঠের মজুদ গড়ে তোলা হয়েছে। ফিক্সড চিমনির ওইসব অবৈধ ভাটা পরিবেশ অধিদপ্তর বা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ যেন ভেঙে না দেয় সেজন্য কৌশলে বেশকিছু ইটভাটার মালিক হাইকোর্টে রিট করে ইট তৈরি অব্যাহত রেখেছে। তারা প্রতিবছরই এভাবে হাইকোর্টে রিট করে ইটের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। আর ২৫ থেকে ২৬টি ভাটা পুরোটাই অবৈধভাবে চলছে।

অপরদিকে, চলতি মৌসুমে উপজেলার কাদিরাবাদে মাজহারুল হক ও গোপীনাথপুরে মাবু মিয়া অবৈধভাবে নতুন ফিক্সড চিমনির ভাটা করেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার এসব ভাটায় ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে বিশাল মজুদ করা হয়েছে। কোথাও কয়লা চোখে পড়েনি। কেবল গাছপালা ও বাঁশের মোথা দিয়েই ইট পোড়ানো হচ্ছে। ভাটা মালিকরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কেউই আইন মানছেন না। দেদারছে কাঠ পোড়ানোর কারণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ।

তবে জমির মালিকরা জানান, প্রতিবিঘা (৫০ শতক) জমি আবাদের জন্য লিজ দিলে বছরে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু মাটি বেচলে পাওয়া যায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা।

উপজেলার চৈত্রকোল ইউনিয়নের দানিশনগর গ্রামে মমিনুর রহমানের ভাড়া নেওয়া অবৈধ ফিক্সড চিমনির ইটভাটায় পোড়ানোর জন্য প্রায় ২০ হাজার মণ কাঠ মজুদ রয়েছে।

কুমেদপুর ইউনিয়নে ফারুক মিয়ার দুটি ইটভাটার জন্য প্রায় দুই লাখ মন কাঠ মজুদ করা হয়েছে। একইচিত্র উপজেলার সকল ইটভাটায়।

ভাটাসংলগ্ন এলাকার কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেভাবে কাঠের কালো ধোঁয়া হচ্ছে, তাতে স্বাস্থ্যহানি এবং পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। আমরা প্রশাসনের কাছে ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধের দাবি জানাই।

ভেণ্ডাবাড়িতে মমিন মিয়ার ধানের চাতালেও প্রায় ৪০ হাজার মণ ছোট ছোট গাছের কাঠ ইট পোড়ানোর জন্য মজুদ করা হয়েছে। তাঁর ইটভাটায় গতবছর ‘এমআরবি’ ব্র্যান্ডের ইট তৈরি করলেও এবার কাস্টমকে ভ্যাট ফাঁকি দিতেই ‘ভিভিবি’  নামে ইট তৈরি করা হচ্ছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।

উপজেলা ভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ভাটাগুলোতে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে বলে বিভিন্ন এলাকা থেকে সচেতন মানুষ জানিয়েছেন। এ উপজেলায় মাত্র ৪-৫টি ভাটার বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। কিছু ভাটার মালিক হাইকোর্টে রিট করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। বিধির বাইরে এবারে আরো দুটি ফিক্সড চিমনির নতুন ভাটা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, উন্নয়ন কাজের জন্যই ইট তৈরি করা দরকার এবং তা বিধি অনুযায়ী হওয়া দরকার।

তবে তিনি জমির টপ সয়েলের ব্যাপারে কোন কথা বলেননি।

উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে জানা যায়, জমির ৪ থেকে ৬ ইঞ্চি মাটিতে বেশি পুষ্টি থাকে। যা ফসল উৎপাদনে খুবই সহায়ক। কৃষকদের অস্বচ্ছলতার সুযোগে ভাটা মালিকরা জমির মালিকদের উদ্বুদ্ধ করে ইট তৈরির জন্য কৃষি জমির টপ সয়েল কিনছেন। ভাটায় প্রতিবছর টপ সয়েল ব্যবহার করায় জমির পুষ্টিগুণ ও উৎপাদন শক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আর কৃষকরা জমিতে সারের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবে টপ সয়েল তুলে নেওয়া অব্যাহত থাকলে ভতিষ্যতে জমিগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিরোদা রাণী রায় বলেন, ‘ইতোমধ্যে ভাটা মালিকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা যেন ভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ-খড়ি ব্যবহার না করেন। অন্যথায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ