অনিয়ম ঠেকাতে আঙুলের ছাপে সরকারি চাল

কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস) চাল নিয়ে চালবাজি বন্ধে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাকিব হাসান। দেশে এই প্রথম চাল বিতরণে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে এলাকায় ব্যপক সাড়া ফেলে দিয়েছেন প্রশাসনের মেধাবী এ কর্মকর্তা।

 

গরিবের চাল নিয়ে কেউ যেন আর কেলেঙ্কারি করতে না পারে, সে লক্ষ্যে নতুন এ প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা হয়। দেশে এই প্রথম বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙুলের ছাপসহ ১৩টি ডাটা সংরক্ষণের মাধ্যমে সঠিক ব্যক্তি নির্ণয় করে দেয়া হবে সরকারি বরাদ্দের চালসহ নানা সামগ্রী।

এদিকে দুর্নীতিবাজ ও চালবাজদের কারসাজিতে দীর্ঘ বছর ধরে এ উপজেলায় নিজেদের নামে কার্ড থাকলেও চাল পাচ্ছিল না অসংখ্য ভুক্তভোগী। কিন্তু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্যোগে নতুন প্রযুক্তির ফলে এখন নিয়মিত চাল পাচ্ছেন অনেক বঞ্চিত হতদরিদ্র।

এতে উপজেলার হাজার হাজার সুবিধাভোগীর মাঝে স্বস্তি বিরাজ করছে। অন্যদিকে ইউএনওর এমন উদ্যোগের বেশ প্রশংসা করেছেন এলাকার সুশীল সমাজসহ সচেতন মহল।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবারকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস) আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাল দিচ্ছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে কুমিল্লার দেবিদ্বারে প্রায় ১০ হাজার হতদরিদ্র পরিবার পাচ্ছেন এ সুবিধা।

কিন্তু সরকারের এ মহৎ উদ্যোগ সর্বত্রই সমালোচিত হচ্ছে একশ্রেণির অসাধু জনপ্রতিনিধি, ডিলার ও প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে। প্রভাবশালী এসব লোক গরিবের চাল নিয়ে বছরের পর বছর চালবাজি করে আসছিল। মৃত ব্যক্তিসহ অসংখ্য ভুয়া নামের তালিকা তৈরি করে সরকারি এ চাল বিক্রি করে দিত।

প্রশাসনের কঠোর অবস্থান এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় বন্ধ করা যাচ্ছিল না এ কেলেঙ্কারি। বিষয়টি নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীও ক্ষোভ প্রকাশ করে এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

এদিকে সারা দেশের ন্যায় কুমিল্লার দেবিদ্বারেও সনাতন পদ্ধতিতে চলছিল চাল নিয়ে চালবাজি। চলতি বছরে করোনাভাইরাসের সময় ওএমএসের চাল নিয়ে চালবাজির গোমর ফাঁস হয়ে যায়।

বেশ কয়েকটি এলাকায় চাল নিয়ে কেলেঙ্কারির খবর ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ডিজিটাল দেবিদ্বারের রূপকার রাজী মোহাম্মদ ফখরুল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি তৈরি করার পরামর্শ দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনও রাকির হাসান ‘ওএমএস দেবিদ্বার’ নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করেন।

এতে উপকারভোগীর নাম, ঠিকানা, ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, আঙুলের ছাপসহ ১৩ ধরনের তথ্য রয়েছে। নতুন এ প্রযুক্তিতে উপকারভোগীকে আসল-নকল যাচাই করে চাল দেয়া হয়। বায়োমেট্রিক পদ্ধতি হওয়ায় একই ব্যক্তি একাধিকবার কিংবা একজনের চাল আরেকজনে উত্তোলন করতে পারবেন না। ওয়েবসাইটে প্রত্যেক উপকারভোগীর তথ্যের বিপরীতে যুক্ত করা হয়েছে তার আঙুলের ছাপ।

উপকারভোগী তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর, ডিজিটাল আইডি নম্বর দিয়ে ব্যবস্থাটিতে (সিস্টেম) প্রবেশ করা মাত্রই তার ছবিসহ যাবতীয় তথ্য প্রদর্শিত হয়। সবার ১০ আঙুলের ছাপ নেয়া হয়েছে। যে কোনো একটি আঙুলের ছাপ দিলে, তা মিললে ‘চাল উত্তোলন সম্পন্ন হয়েছে’, এমন ধন্যবাদ বার্তা দেখায়।

শুধু তাই নয়, উপকারভোগীর চাল উত্তোলনের তথ্য কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার বা সার্ভারেও জমা হয়। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কারা চাল উত্তোলন করেছেন, কারা করেননি, তার তথ্য জানতে পারেন। ফলে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকে না।

শুরুতেই দেবিদ্বারের ধামতী ইউনিয়নে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙুলের ছাপ দিয়ে ওই চাল বিতরণ শুরু করা হয়।

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, উপজেলার সুবিল ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. নজরুল ইসলাম সরকার গত তিন বছর আগে মারা গেছেন। কিন্তু মৃত এ ব্যক্তির নামে তিন বছর ধরে চাল উত্তোলন করা হচ্ছে।

একইভাবে উপজেলার গুনাইঘর দক্ষিণ ইউনিয়নের উজানীজোড়া গ্রামের রাশেদা বেগম ও সুফিয়া খাতুনের নামে ১৮ থেকে ২২ বার চাল উত্তোলন করা হয়েছে। অথচ তালিকাভুক্ত এসব হতদরিদ্র জানেই না তার চাল কে নিচ্ছে আর কে লুটেপুটে খাচ্ছে।

পরে ইউএনও রাকিব হাসানের অনুসন্ধানে এ ধরনের অসংখ্য কেস ধরা পড়ে। এসব অনিয়মের ইতি টানতেই নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করা হয়েছে। নতুন এ ফর্মুলায় আর প্রতারিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাকিব হাসান।

এ বিষয়ে দেবিদ্বারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাকিব হাসান বলেন, অনেকের নামে কার্ড করা হয়েছে, অথচ তারা জানেন না, তাদের নামে বছরের পর বছর চাল তোলা হচ্ছে। ক্রমাগতভাবে যখন অভিযোগগুলো আসছিল, তখন ভাবলাম প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি ব্যবস্থা দাঁড় করাব, যাতে একজনের কার্ডের চাল আরেকজন নিতে না পারে।

‘ব্যবস্থাটি তৈরির জন্য ডিলার ও উপকারভোগীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। পর্যায়ক্রমে সবকটি ইউনিয়নে ব্যবস্থাটি চালু করা হবে।

পুরো উপজেলার সবাইকে এর আওতায় আনা হবে। ওয়েবসাইট আরও হালনাগাদ করব।’

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর বলেন, ওএমএসের চাল বিতরণে অনিয়ম ঠেকাতে এটি একটি কার্যকর পদ্ধতি। আমরা একই পদ্ধতিতে সরকারের অন্যান্য সেবাও দেয়ার চেষ্টা করছি।

 

সূত্রঃ যুগান্তর