অনিয়মের আখড়া বিএমডিএ: নাটের গুরু নির্বাহী পরিচালক

নিজস্ব প্রতিবেদক:
খাল খনন, টেন্ডার, কোটেশন, বিদ্যুৎ ব্যবহার, বেতন বৃদ্ধি, ভ্যাট কর্তনসহ নানাকাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) বিরুদ্ধে। এ নিয়ে দফায় দফায় অডিট আপত্তি থাকা সত্তেও একই কাজ করে চলেছে কর্তৃপক্ষটি। ফলে বছরে সরকারের কোটি কোটি টাকা তোছরুপ করা হচ্ছে এসব কাজের মাধ্যমে। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝেও।

অভিযোগ উঠেছে, দীর্ঘদিন ধরে ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক হিসেবে একই পদে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এসব অপকর্মের নাটেরগুরুতে পরিণত হয়েছেন তিনি। এছাড়াও সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ, জোর করে তাদের দাবি না মানা, নির্যাতনসহ নানা অভিযোগও রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশিদের বিরুদ্ধে রাজশাহী শ্রম আদালতে একটি মামলাও বিচারাধীন রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএমডিএ’র বাণিজ্যিক অঢিট শাখা পরিচালিত ২০১২-১৭ সাল পর্যন্ত ৫ বছরের অডিটেই উঠে এসেছে ৬ কোটি ৬৯ লাখ ৮৫ হাজার ৫৭৯ টাকার অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। বিএমডিএ’র ২৪টি খাতে দায়সারা গোছের ওই অডিটেই সরকারের এই বিপুল পরিমাণ টাকা ক্ষতির তথ্য উঠে এসেছে। তবে পূর্ণাঙ্গভাবে অডিট করা হলে আরো বিভিন্ন খাতসহ বিএমডিএতে ৫ বছরেই অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা লোপাটারে তথ্য উঠে আসবে বলেও দাবি করেছে একাধিক সূত্র।

বিএমডিএ’র বাণিজ্যিক অডিট শাখা পরিচালিত ২০১২-১৭ সাল পর্যন্ত অডিটে যেসব অনিয়মের চিত্র উঠে আসে তার মধ্যে রয়েছে, কর্তৃপক্ষের জোন পর্যায়ের ভবনের তৃতীয় তলা সহকারী প্রকৌশলীদের আবাসিক ভবন হিসেবে নির্মাণ করা হলেও তা বরাদ্দ না দিয়ে ফেলে রাখার ফলে সংস্থার ক্ষতি হয়েছে ৬৩ লাখ ৯৬ হাজার ৬০৩ টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশ অমান্য করে কর্মকর্তাদের টাইমস্কেলে বেতন নির্ধারণের সময় অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট হিসেবে প্রদানকৃত অর্থ আদায় না করায় সংস্থার ক্ষতি হয়েছে ৫৬ লাখ ৬০ হাজার ৬৩৯ টাকা।

পল্লী বিদ্যুৎ থেকে বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুত কিনে সেটি আবাসিক বাসায় সরবরাহের ফলে ক্ষতি হয়েছে ৩ লাখ ৩৭ হাজার ১৭ টাকা। মেটাল ফাউন্ডারি ইন্ডাস্ট্রিজ এর বিল হতে প্রযেওজ্য হার অপেক্ষা কম হারে ভ্যাট কর্তন করায় রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৫ টাকা। বিলম্বে কাজ সম্পাদন করার পরেও ঠিকাদারের বিল হতে বিলম্ব ফি কর্তন না করে ক্ষতি করা হয়েছে ৯ লাখ ২৪ হাজার ৪৬৩ টাকা।

পার্টিসিপেশন ফি এর উপর প্রযোজ্য মুসক সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে ক্ষতি করা হয়েছে ২৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪৪৭ টাকা। পুন:টেন্ডার আহ্বান না করে যোগসাজসের মাধ্যমে নামমাত্র মূল্যে আমসহ ফলগাছ ইজারা দিয়ে ক্ষতি করা হয়েছে ৫ লাখ ২২ হাজার ৮৯৬ টাকা। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমদোন এড়ানোর লক্ষ্যে টেন্ডার আহ্বান ছাড়ায় কোটেশনের মাধ্যমে খন্ড খন্ডভাবে ক্রয় করে ক্ষতি করা হয়েছে ৪৭ লাখ ৯২ হাজার ৯২৫ টাকা।

পিপিআর লঙ্ঘন করে সরকারি ক্রয় পদ্ধতিতে আর্থিক ক্ষমতার অতিরিক্ত মূল্যের পণ্য ক্রয় করে সংস্থার ক্ষতি করা হয়েছে ১৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৫০ টাকা। পিপিআর লঙ্ঘন করে কোটেশনের মাধ্যমে উন্নয়ন বাজেটের আওতায় ৫৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৬৬ টাকার পণ্য ক্রয় এবং ৮৭ লাখ ৭৭ হাজার ৬৮৯ টাকার কাজ করে সরকারি ক্ষতি করা হয়েছে এক কোটি ৪ লাখ ৬১ হাজার ৫৫৫ টাকা। সরকারি বিধিমালা লঙ্ঘন করে ঠিকাদারকে মসূল কাজের ২০ ভাগ অতিরিক্ত কাজ দিয়ে ক্ষতি করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৯৭০ টাকা।

কোটেশনের শর্তমোতাবেক যোগ্য দরদাতা না পাওয়া সত্তেও কার্যাদেশ দিয়ে ক্ষতি করা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৯৭ টাকা। আবার বিধি লঙ্ঘন করে ঠিকাদারকে মূল ক্রয়ের অতিরিক্ত ২০ ভাগ পণ্য ক্রয়ের মাধ্যমে সরকারি ক্ষতি করা হয়েছে এক কোটি ৮০ লাখ ৮৬ হাজার ৫০৮ টাকা।

এভাবে সবমিলিয়ে কেবলমাত্র ২৪টি খাতেই ৫ বছরে সরকারের ৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকারও বেশি ক্ষতি করা হয়েছে। তবে এই ক্ষতির পরিমাণ আরো কয়েকগুন বাড়বে বলেও দাবি করেছেন সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।

তাদের দাবি, বিএমডিএ’র বাণিজ্যিক অডিট শাখা ছাড়াও সরকারি অডিটেও ধরা পড়ে নানা অনিয়মের চিত্র। কিন্তু এসব গোপন থেকে যায়। আবার অডিট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে কখনো কখনো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনও দাখিল করতে দেওয়া হয় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, ‘বিএমডিএ এখন লুটপাটের একটি সংস্থায় পরিণত হয়েছে। সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানটির কোনো কাজই এখন আর নিয়মের মধ্যে থেকে হয় না। সবখানেই লুটতরাজদের হাতছানি। ফলে বছর বছর সরকারি অর্থ যেমন লোপাট হচ্ছে, তেমনি সরকারের উদ্দেশ্যেও বিফলে যাচ্ছে।

এই সংস্থার প্রতিটি প্রযেক্টেই এখন পুকুর চুরির মতো অনিয়ম ঘটছে। যার নেপথ্যে কাজ করছেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক নিজেই। এ কারণে বার বার অডিট আপত্তি থাকা সত্তেও একইভাবে অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে সংস্থাটি।

এদিকে কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি না মানায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদের রাজশাহী শ্রম আদালতে একটি মামলা এখনো বিচারাধীন রয়েছে। বিএমডিএ’র সিবিএ’র পক্ষ থেকে গত ৫ মার্চ অভিযোগ করা হলে আব্দুর রশিদের বিরুদ্ধে এ মামলাটি দায়ের করা হয়। এছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানাভাবে হুমকি-ধমকি এমনকি নির্যাতনের অভিযোগ করা হয় বিভিন্ন দপ্তরে।

তবে অডিট আপত্তি সম্পর্কে ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদের মন্তব্য হলো, ‘কাজ করতে গেলে অডিট আপত্তি উঠবেই। সেগুলো নিস্পত্তিও হবে। তবে আমি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নয়। তার পরেও যেসব অভিযোগ আছে সেগুলো সঠিক নয়।’

আরকে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিচারাধীন মামলা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয়।