‘অক্টোবর ট্রাজেডি’ – ৩৫ বছর আগে যে রাতে ধসে পড়ে জগন্নাথ হলের ভবন

ঠিক ৩৫ বছর আগে, ১৯৮৫ সালের ১৫ই অক্টোবর জগন্নাথ হলের একটি হলরুমের ছাদ ধসে পড়ে মারা গিয়েছিলে ৪০ জন, যে ঘটনার স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শোক দিবস পালন করা হচ্ছে।

যেই ভবনটির ছাদ ধসে দুর্ঘটনাটি ঘটে, ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সেটিকে বলা হতো ‘পরিষদ ভবন’ বা ‘অ্যাসেম্বলি হল।’ একশো বছরেরও বেশি পুরনো অডিটোরিয়ামটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের পরিষদ ভবন বা সংসদ ভবন ছিল, তাই এটি অ্যাসেম্বলি হল বা পরিষদ ভবন হিসেবে পরিচিত ছিল।

পরে নতুন পরিষদ ভবন তৈরি হলে ওই ভবনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এরপর ১৯৮৫ সালের ১৫ই অক্টোবরের মর্মান্তিক ঘটনার আগে পর্যন্ত এটি জগন্নাথ হলের টেলিভিশন কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ওই রাতে পুরনো ভবনটির ছাদ ধসে পড়ে, আর মারা যান ৪০ জন, আহত হন শতাধিক।

ওই সময়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে সেই রাতটি আজও অক্টোবরের ট্রাজেডি।

কলা ভবনের সামনে অপরাজেয় বাংলাদেশ

প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে সেদিনের ঘটনা

ঘটনার রাতে টিভি রুমের ভেতরে ছিলেন স্বপন কুমার দে, যিনি বর্তমানে জগন্নাথ হল কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সভাপতি। সেই সময়ের কিশোর স্বপন কুমার দে’র বর্তমান বয়স ৫১।

তার বাবা জগন্নাথ হলের বাগানের মালী হিসেবে কর্মরত ছিলেন, সেই সূত্রে হল এলাকার ভেতরেই বাস করতো তার পরিবার।

“সেদিন বিকেল থেকেই প্রচুর ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। দুর্ঘটনার সময়ও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি চলছিল,” – সেই রাতের কথা স্মরণ করছিলেন স্বপন দে।

সেদিন রাতে সাড়ে আটটার সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় নাটক ‘শুকতারা’ দেখার জন্য তিনি টিভি কক্ষের ভেতরে গিয়ে বসেছিলেন তিনি।

ওই সময় রুমের ভেতরে আনুমানিক দেড় থেকে দুইশো’ মানুষ ছিল বলে ধারণা করেন স্বপন কুমার দে। তবে পরের দিনে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা এবং ওই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন লেখকের লেখায় উপস্থিত মানুষের সংখ্যা তিনশো’ থেকে চারশো’ ছিল বলেও উল্লেখ করা হয়।

দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপ চলছিল তখন, আর এর প্রভাবে ঢাকায় বাতাস বইছিল, সাথে ছিল ভারী বৃষ্টিপাত।

“হলের ভেতরে সারিবদ্ধভাবে অনেকগুলো চেয়ার রাখা ছিল। আর চেয়ারগুলোর সামনে টেলিভিশনের কাছে একটি কাঠের চৌকি ছিল। আমি আরও বেশ কয়েকজনের সাথে ঐ চৌকিতে গিয়ে বসি,” স্মরণ করেন স্বপন দে।

সাড়ে আটটায় নাটক শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দুর্ঘটনাটি ঘটে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল

“নাটক চলতে চলতেই হঠাৎ এক সময় মনে হয় ছাদ থেকে বালির গুড়া পড়ছে মাথায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড শব্দ শুনি, আর বুঝতে পারি যে আমাকে দুই দিক থেকে শূন্যে তুলে সরিয়ে নেয়া হলো।

“কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখতে পাই আমি আরও কয়েকজনের সাথে টিভির পেছনে দাঁড়িয়ে আছি।

“ছাদ ধসে পড়ার আগের মুহূর্তে দু’জন ছাত্র দুই পাশ দিয়ে আমাকে ধরে টেলিভিশনের পেছনের জায়গাটায় নিয়ে আসে। চৌকিতে যারা বসে ছিল, তাদের অনেকেই শেষমুহুর্তে ঐখানে এসে আশ্রয় নিতে পেরেছিল।”

এরপরের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে স্বপন কুমার দে’র কণ্ঠ।

“একটু ধাতস্থ হওয়ার পর আশেপাশে থেকে শুধু ‘বাবারে, মা’গো, বাঁচাও’ এসব আর্তনাদ শুনছিলাম। তখনও মাথায় ছিল না দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গিয়েছিল কি-না। অনেকটা পাগলের মত ছুটে বের হয়ে যাই ওখান থেকে।

“বাইরে গিয়ে সবাইকে একটা কথাই বলতে থাকি, ‘ছাদ ধসে পড়েছে।'”

আশেপাশের মানুষকে খবর জানিয়ে ঘটনাস্থলে ফিরে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ অপ্রকৃতস্থ ছিলেন বলে জানান স্বপন কুমার দে।

“তখন আমার বয়স কম ছিল। রক্ত, মৃত্যু, আর্তনাদের মধ্যে কিছুতেই মাথা ঠিক রাখতে পারছিলাম না।”

ওই সময়ের সংবাদপত্র থেকে জানা যায় যে ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে ৩৪ জন মারা যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ৫ জনের মৃত্যু ঘটে।

জগন্নাথ হলের নতুন অক্টোবর স্মৃতি ভবন

জগন্নাথ হলের ভবন ধসেন ঘটনায় ঠিক কতজন আহত হয়েছিলেন, তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে পত্রিকাগুলোর রিপোর্টে শতাধিক আহত হওয়ার খবর বলা হয়।

পরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক তদন্তে বলা হয় যে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে পুরনো ও জীর্ণ ভবনটি ধসে এই দুর্ঘটনা ঘটে।

ভবন ধসের পর পুরো ভবনটিই গুড়িয়ে দেয়অ হয়। পরে ওই একই জায়গায় ‘অক্টোবর স্মৃতি ভবন’ নামে জগন্নাথ হলের নতুন একটি ছাত্রাবাস তৈরি হয়।

আর ঘটনার পরের বছর থেকেই ১৫ই অক্টোবর পালিত হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস’ হিসেবে।

 

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা