ওয়ালিউর রহমান বাবু :
রাজশাহী জেলা সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে উত্তর-পশ্চিমে রহনপুর। ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা এখানকার ১১ টি গ্রামে নারকিয়তা চালায়। সেই কথা এখন ও সেখানকার মানুষ ভুলে যায়নি। এখনো তারা শিউরে ওঠে। মাঝ দিয়ে বইছে মহানন্দা নদী। নদীর পূর্ব অংশে গোমস্তপুর থানার রহনপুর অংশ। পশ্চিম অংশে নদীর তীর ঘেঁষে আম গাছে ঢাকা সমৃদ্ধশালী বোয়ালিয়া ইউনিয়নের ১১ টি গ্রাম। এই গ্রামগুলির অনেকেই তখন মুক্তিযুদ্ধে। দলদলি কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট রফিকুল ইসলাম সঙ্গীদের নিয়ে এই ইউনিয়নের ঘাটনগর, দরবারপুর, বৈরতলা, কাঞ্চনতলা, গৌরীপুর, লক্ষিনারায়ণপুরে পজিশন নেন।
প্রতিদিনই মুক্তিযোদ্ধারা রহনপুরে পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্প ও নদীর ওপারে অবস্থান নেয়া পাকিস্তানী সৈন্যদের ওপর সেলিং করতে থাকে। এইভাবে চলে ৭ দিন। ১৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা সারারাত রহমপুর ক্যাম্প ও তাদের অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর সেলিং করতে থাকে। ১৯ সেপ্টেম্বর জুম্মার দিন খুব ভোরে পাকিস্তানি সৈন্যরা মেজর ইউনুস, ক্যাপ্টেন লোদিন নির্দেশে নৌকা, লঞ্চে নদী পার হবার চেষ্টা করতে থাকলে পজিশনে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এই প্রতিরোধে পাকিস্তানী সৈন্যরা নাজেহাল হতে থাকলে প্রতিশোধ নিতে আর্টিলারী ফোর্স নিয়ে নদী পার হয়ে চৌডালা- গৌরীপুর দিয়ে প্রবেশ করে গুলি করতে করতে বোয়ালিয়া গ্রাম আক্রমণ করে। দরবারপুর, ঘাট নগরে মসজিদে ফজরের নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিরা ভাবে নারায়ে তাগবির আল্লাহু আকবার, পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান দিলে পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করবে না। গ্রামের লোকজন বেঁচে যাবে।
মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান পন্থীদের সিদ্ধান্তে নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিরা গ্রামের লোকজন নিয়ে আল্লাহু আকবার পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের স্বাগত জানাতে সামনের দিকে অগ্রসর হতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের উপর গুলি চালাতে থাকে। বেয়েনেট র্চাজ করে হত্যা করে মুসল্লিসহ অসংখ্য গ্রামবাসীকে। শুরু করে তান্ডব। বাড়িঘরে দিতে থাকে আগুন। গ্রামের লোকজন দিকবিদিক দৌড়াতে থাকে এসময় পাকিস্তানি সৈন্যরা দরবার-পুর, ঘাটনগরের নারী ও শিশুদের নদীর ধারে ধারে আনলে নারীরা ভাবে তারা বেঁচে যাবে। কিন্তু তাদের লাইন করিয়ে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি চালাতে থাকে। হত্যা করে অগুনতি নারী শিশুকে।
বাঁচার জন্য অনেক নারী নদীতে লাফ দিলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদেরও গুলি করে। এক নারী তার শিশুকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি করে তাদের ও হত্যা করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রখ্যাত গম্ভীরা শিল্পী নূর কুতুবুল আলমের শাশুড়ী রাবেয়া খাতুন তার এক বছরের শিশু নয়ন, চার বছরের শিশু সজল কে অন্যান্যদের সাথে ধরে এনে লাইনকরিয়ে গুলি করে হত্যা করে রাবেয়া খাতুন, শিশু নয়ন ও সজলকে। এই দুই শিশুর মা তাহেরা খাতুন কিছু সময় বেঁচে থাকার পর মারা যান। আহত সাহেরা খাতুন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেন। লক্ষ্মী নারায়ন-পুরে পাকিস্তানি সৈন্যরা নারী ও পুরুষদের লাইন করিয়ে গুলি চালাতে থাকে। নামুটলায় পাকিস্তানি সৈন্যদের বেয়েনেট চার্জে এক নারীর পেট থেকে নিচে পড়ে গেল একটি শিশু। এভাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা বোয়ালিয়া ইউনিয়নের ১১ টি গ্রামের ৫০০ নারী-পুরুষকে হত্যা করে। বাড়িঘর গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বহু নারীকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে নিহতদের লাশ দাফন করার সুযোগ না থাকায় ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীতে।
পাকিস্তানি সৈন্যদের নারকীয়তার খবর পেয়ে ৭নং সেক্টরের কমান্ডার লেঃ কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান মোহদীপুর সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর দলদলি কোম্পানী হেডকোয়াটার লেফটেন্টেট রফিকুল ইসলামকে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেন। মোহদীপুর সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেদিকে অ্যাডভান্সের পরিকল্পনা করে শুরু করেন অ্যাকশন অপারেশন। শহিদ পরিবারের সন্তান পাকিস্তানি সৈন্যদের নারকীয়তা থেকে বেঁচে যাওয়া দরবারপুরের জামাল উদ্দিন তখন স্কুল ছাত্র প্রত্যক্ষ করেন সেই নারকীয়তা।
বলেন তিনি হারিয়েছেন মা রাবেয়া খাতুন বোন হাজেরা খাতুন, তার আদরের ভাগ্গা নিষ্পাপ শিশু নয়ন ও সজলকে। তার আরেক বোন সাহেবা খাতুন মারাত্মক আহত হন। সেদিনের সে নারকীয়তা ভুলে যাওয়া যায় না। তার মত অনেকেই হারিয়েছেন আপনজন, স্বজনদের। ঢুকড়ে কেঁদে ওঠে বলেন, “বাবু বুকের মধ্যে কেমন যেন করে। থাক না এসব কথা কি প্রয়োজন? দোসরা কৌশলে পার পেল, আর স্বার্থবাদীরা স্বার্থ হাসিল করলো। ইতিহাসের পাতায় এই অঞ্চলের স্থান নেই। প্রজন্মদেরকে জানতে দেয়া হয় না সেই নারকীয়তার কথা। বোয়ালিয়া ইউনিয়নের এই ১১ টি গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যদের নারকীয় তান্ডবের কথা” এই পাশবিকতার সাক্ষী অনেকে। কেউ এগুলি বলতে চায় আবার কেউ বলতে চায় না। তাদের হৃদয়ে এই সব ঘটনা পাথরের মত শক্ত হয়ে আছে।
(লেখক- তথ্য সংগ্রাহক, রাজশাহী)
০১৯১১-৮৯৪২৬০