শাহরুখ খানের নতুন সিনেমা ’জাওয়ান’ বক্স অফিসে রীতিমতো ঝড় তুলেছে। বিশ্বব্যাপী এখন পর্যন্ত ৯৫৩ কোটি রুপির ব্যবসা করেছে সিনেমাটি। শিগগিরই এটি হাজার কোটি রুপির মাইলফলক স্পর্শ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
‘জাওয়ান’ শাহরুখ খানকে দারুণ সাফল্য এনে দিয়েছে। এর সঙ্গে সফলতার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে সিনেমার পরিচালক অ্যাটলি কুমারের পালকে।
অ্যাটলি এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচটি সিনেমা পরিচালনা করেছেন। এরপরেও তিনি এই সময়ে ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক হয়ে উঠেছেন। অ্যাটলিকে প্রথম দেখে এটা অনেকেরই বিশ্বাস হবে না যে তিনিই সেই মানুষটা যিনি বক্স অফিসের পুরোনো সব রেকর্ড ভেঙে নতুন নতুন রেকর্ড করছেন। কিন্তু পাতলা শরীর এবং অনানুষ্ঠানিক শরীরী ভাষা নিয়ে অ্যাটলি স্বাচ্ছন্দ্যেই দাবি করতে পারেন যে তার কোনো সিনেমাই এ পর্যন্ত ফ্লপ হয়নি।
অরুণ কুমার থেকে অ্যাটলি পর্যন্ত যাত্রা

অ্যাটলি ১৯৮৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তামিলনাড়ুর মাদুরাই জেলার থিরুপারকুন্ডামে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম অরুণ কুমার।
তিনি চেন্নাইয়ের সত্যবামা কলেজ থেকে ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশনে বিএসসি করেছেন। অ্যাটলি বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক শঙ্করের সহকারী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন।
তিনি ‘নানবান’ (থ্রি ইডিয়টসের তামিল রিমেক) এবং রজনীকান্তের ‘এনথিরান’ (রোবট) সিনেমায় শঙ্করের সহকারী হিসাবে কাজ করেছিলেন।
এ ছাড়া তিনি একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুগাপুত্তাগম’ পরিচালনা করেন।
এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তামিল চলচ্চিত্র অভিনেতা শিবকার্তিকেয়ান। অ্যাটলির সিনেমাটি প্রচুর প্রশংসা পেয়েছে।
এরপর তিনি ‘রাজা’ নামে একটি সিনেমার চিত্রনাট্য নিয়ে কয়েকজন নির্মাতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
তামিল চলচ্চিত্র নির্মাতা এ আর মুরুগাদোস সিনেমাটি তৈরি করতে সম্মত হন। ছবিটি ফক্স স্টার স্টুডিওর ব্যানারে নির্মিত হয়েছিল।
এ সিনেমাতে অভিনয় করেছেন— আরিয়া, জয়, নয়নতারা ও নাজরিয়া নাজিম। এটি ছিল সেই বছরের অন্যতম বড় হিট। এর নির্মাণ ব্যয় ছিল প্রায় ২৫ কোটি টাকা।
বক্স অফিসে ছবিটি প্রায় ৮৪ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল। সমালোচকরাও সিনেমাটির প্রশংসা করেছেন। পরবর্তীতে এই সিনেমাটি বাংলায় নির্মিত হয়।
অ্যাটলি তার প্রথম সিনেমার জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে তামিলনাড়ু সরকারের চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ফিল্মফেয়ার পুরস্কার।
বড় তারকাদের সঙ্গে কাজ
দ্বিতীয় সিনেমাতে অ্যাটলি তামিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বড় তারকা বিজয়ের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই সিনেমার নাম ছিল ‘থেরি’। এর প্রযোজক ছিলেন কালিপুলি থানু।
বিজয় ছাড়াও এতে কাজ করেছেন সামান্থা ও জ্যাকসন। সিনেমাটি সমালোচকদের খুব প্রশংসা না পেলেও প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছে।
‘থেরি’র পর বিজয় অ্যাটলিকে আরেকটি সিনেমা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। এই সিনেমার নাম ছিল ‘মেরাসাল’। বিজয় ছাড়াও এতে কাজ করেছেন কাজল আগরওয়াল, সামান্থা ও ভাদিভেলু। সিনেমাটি বক্স অফিসে দুর্দান্ত হিট হয়েছিল।
সিনেমাটি প্রায় ২৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল। এটি সেই সময়ে একটি বিশাল তামিল হিট ছিল। সিনেমাটি ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ সিনেমা হল গ্র্যান্ড রেক্সে প্রদর্শিত হয়।
বিজয়ের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছেন অ্যাটলি
বিজয় অ্যাটলির পরবর্তী সিনেমা ‘বিগিল’-এও কাজ করেছিলেন। সিনেমাটি প্রথম দিনে ৫৮ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল। পরের চার দিনে ৭৫ কোটি টাকার ব্যবসা করে।
সিনেমাটির নির্মাণকারী সংস্থা এজিএস জানিয়েছে, সিনেমাটি ৩০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যবসা করেছে। এটি বিজয়ের প্রথম সিনেমা, যা ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে।
বিগিলের প্রযোজনার সময়ই জানা গিয়েছিল যে অ্যাটলি তার পরবর্তী সিনেমাতে অভিনেতা শাহরুখ খানকে রাখছেন। অবশেষে ২০২২ সালের জুনে এটি ঘোষণা করা হয়। এটি ছিল অ্যাটলির পঞ্চম চলচ্চিত্র।
৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঝুঁকি নিয়েছিল প্রযোজনা সংস্থা। মিশ্র প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও অ্যাটলির পঞ্চম সিনেমা ‘জাওয়ান’ বক্স অফিসে ভালো ব্যবসা করছে।
হিন্দুস্থান টাইমসের ২৩ সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, ‘জাওয়ান’ এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৯৫৩ কোটি রুপির বেশি আয় করেছে।
অ্যাটলির দুর্দান্ত শক্তি
মাত্র পাঁচটি সিনেমা দিয়ে অ্যাটলি তার সিনেমা সম্পর্কে একটি পরিচয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি সিনেমা নির্মাণে সেরা পেশাদারদের ব্যবহার করেন।
তার প্রথম দুটি সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেছিলেন জিভি প্রকাশ কুমার। প্রকাশ এ আর রহমানের ভাগনে। তার পরবর্তী দুটি সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেছিলেন এ আর রহমান।
‘জাওয়ান’-এর সংগীত পরিচালনা করেছেন অনিরুদ্ধ। তার প্রথম দুটি সিনেমার চিত্রগ্রাহক ছিলেন জর্জ সি উইলিয়ামস এবং পরবর্তী তিনটি সিনেমাতে জি কে বিষ্ণু। একইসঙ্গে সম্পাদনার জন্য তিনি রুবানের ওপর ভরসা রেখেছেন।
এগুলো ছাড়াও অ্যাটলির বড় শক্তি এস রমনগিরি ভাসান। আগে তিনি টিভিতে লিখতেন। তিনি অ্যাটলির সাথে ‘থেরি’ সিনেমার সংলাপগুলো রচনায় সহযোগিতা করেছিলেন।
তিনি ‘মার্শাল’ এবং ‘বিজলি’ সিনেমারর চিত্রনাট্য রচনাতেও অবদান রেখেছিলেন। ভাসান ‘জাওয়ান’ সিনেমার চিত্রনাট্যেও অবদান রেখেছেন।
অ্যাটলির সমালোচনা কেন হচ্ছে
অ্যাটলির সিনেমা নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে তার সিনেমাগুলো অন্য আর ১০টা সিনেমার মতোই। অর্থাৎ বিশেষ ভালো কিছু তার সিনেমায় থাকে না।
তার সিনেমা ‘রাজা রানী’ মণিরত্নমের ১৯৮৬ সালের তামিল সিনেমা ‘মাওনা রাগাম’ এবং ২০০৭ সালের কন্নড় সিনেমা ‘মিলানা’র অনুরূপ বলে জানা গেছে।
একইভাবে, তার ভক্তরা মনে করেন যে ‘থেরি’ সিনেমাটি বিজয়কান্তের ১৯৯০ সালের সিনেমা ‘ছত্রিয়ান’-এর অনুরূপ।
তার ভক্তরা মনে করছেন, শাহরুখ খানের ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ সিনেমা থেকে ‘বিগিল’-এর অনেক দৃশ্য নেওয়া হয়েছে। এখন ‘জাওয়ান’-এর ক্ষেত্রেও একই কথা বলা হচ্ছে।
তার ভক্তরা মনে করেন যে এটি অন্যান্য অনেক সিনেমার মতোই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে অনেকেই লেখালেখি করছেন।
অ্যাটলি কীভাবে সিনেমা তৈরি করেন
অ্যাটলির সিনেমাগুলো খুবই নাটকীয়। তার চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত উসকানিমূলক দিকটি সাধারণ জীবনে দৃশ্যমান নয়। বলা যেতে পারে যে এই ক্ষেত্রে তিনি তাঁর গুরু শঙ্করকে অনুসরণ করেন।
তামিল সিনেমার সমালোচকরা শঙ্কর-অ্যাটলিকে কেবল ভালো ব্যবসায়িক পরিচালক হিসাবে বিবেচনা করেন।
তবে অ্যাটলির কাজের প্রশংসা যারা করেন তারা বলেন— এটা সত্য যে অ্যাটলি পুরোনো সিনেমাগুলো রিক্রিয়েট করেন। এ জন্য তার সমালোচনাও হচ্ছে। তবে তার প্রতিভা হলো এমন সিনমো তৈরি করা যা মানুষ উপভোগ করে। সেখানেই তার সাফল্য। এ ছাড়া অ্যাটলি নিজের একটি স্টাইলও গড়ে তুলেছেন। তার যতই সমালোচনা হোক বাণিজ্যিক সিনেমায় বক্স অফিস সংগ্রহই গুরুত্বপূর্ণ। একজন পরিচালক বাণিজ্যিকভাবে সফল চলচ্চিত্র দে ন কিনা তা গুরুত্বপূর্ণ। এমন পরিস্থিতিতে অ্যাটলি একজন গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র পরিচালক।
বলিউডে অ্যাটলির জায়গা কোথায়?
তামিল সিনেমার অনেক পরিচালকই বলিউডে কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন বিখ্যাত পরিচালক এস এস ভাসান।
তিনি ছাড়াও, আরেক বিশিষ্ট তামিল চলচ্চিত্র নির্মাতা কে বালাচন্দর ৮০ এর দশকে কয়েকটি হিন্দি সিনেমা পরিচালনা করেছিলেন।
এর পরে মণি রত্নম, শঙ্কর এবং এ আর মুরুগাদোস তামিল এবং হিন্দিতে সিনেমা পরিচালনা করেছেন।
প্রভু দেবাও বেশ কয়েকটি হিন্দি সিনেমা পরিচালনা করেছেন।
রাঘব লরেন্সও একটি হিন্দি সিনেমা পরিচালনা করেছেন। এখন বলিউডে অ্যাটলির অবস্থান কোথায় ‘জাওয়ান’ ঝড়ের পর তা জানতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।