শুক্রবার , ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সক্ষমতার ডানায় আকাশে শান্তির নীড়

Paris
সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩ ৩:০৬ অপরাহ্ণ

মিনার সুলতান

জাতির স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্বের প্রতীক জাতীয় পতাকা বহন করে চলেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। একটি মাত্র ডিসি উড়োজাহাজ নিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে জাতির পিতার হাত ধরে যাত্রা শুরু করা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে একটি থেকে ২১টিতে উন্নীত হয়েছে বিমানের বহর। জীর্ণতা ছেড়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম তারুণ্যদীপ্ত বহর হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেছে বাংলাদেশ বিমান। গত ২০২১২০২২ অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করে পরিচালন ব্যয় বাদ দিয়ে ৪৩৯.৭৮ কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জন করেছে। আগের বছরেও অর্থাৎ করোনা মহামারির মধ্যে যখন বিশ্বের বৃহৎ এয়ারলাইন্সসহ সিংহভাগ এয়ারলাইন্স লোকসানের মধ্যে ছিল, সে বছরও চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনা করে ১৫৮ কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জন করেছিল বিমান।

 

বিএনপি আমলে কেমন ছিল বিমান?

২০০১ সালে বিএনপিজামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে জাতীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমানকে পরিণত করে দুর্নীতি আর লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে। খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দাররা একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করে বিমানের সাপ্লাই আর এয়ার ক্রাফট ক্রয়। বিএনপি আমলে সীমাহীন দুর্নীতির কারণে- নিউইয়র্ক, ব্রাসেলস, প্যারিস, ফ্রাংকফুর্ট, মুম্বাই, নারিতা এবং ইয়াঙ্গুন রুটে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়। চরম লোকসান আর অব্যবস্থাপনায় বিমান মুখ থুবড়ে পড়ে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছিলেন বিমান প্রতিমন্ত্রী। তিনি সৈয়দপুর বিমানবন্দর প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। রাজশাহী এয়ারপোর্টও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল বিএনপি। আর বরিশাল এয়ারপোর্ট বিমান চলাচল কমে যায়। রাডার স্টেশন ছিল নষ্ট। গোটা বিএনপি আমলে একাধিক আবেদনের পরেও এটা ঠিক করেনি মন্ত্রণালয়। 

 

বিমানের টি ডিসি১০ প্লেনের মধ্যে টিই অচল করে রাখা হয়েছিল। বিএনপিজামায়াত জোট আমলে ডিসি১০ প্লেনের ১০টি ইঞ্জিন বিদেশে মেরামতের নামে পড়ে থাকে। ফলে টির মধ্যে টি ডিসি১০প্লেন আর উড্ডয়ন বন্ধ হয়ে যায়। এর চাপ পড়ল বিমানের তখনকার টি এয়ারবাস এ্যারোপ্লেনের ওপরও। তাই বিমানের সমস্ত সিডিউল ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। প্রতিটি ফ্লাইট ডিলে তখন একটি নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার ছিল।

ডিসি১০ প্লেনের ১০টি ইঞ্জিন ইচ্ছাকৃতভাবে বিদেশে ফেলে রাখা হয়। 

 

নিউইয়র্কে নর্থ আটলান্টিক ট্রাভেল এজেন্সি নাম দিয়ে বিএনপি নেতাদের কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি মিলে একটি সিন্ডিকেট করে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিমানের নিউইয়র্ক অফিসকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিলেন বিএনপি নেতাকর্মীদের ট্রাভেল এজেন্সি ছাড়া অন্যরা বিমানের টিকেট বিক্রি করতে পারবে না। ওই ট্রাভেল এজেন্সিগুলো নিউইয়র্কঢাকানিউইয়র্কের জন্য নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি দামে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করত। ফলে ঢাকানিউইয়র্কের মধ্যে বিমানের যাত্রী কমতে শুরু করে। এক পর্যায়ে বিমানের ঢাকানিউইয়ের্কের ফ্লাইটই বন্ধ করে দেওয়া হয়।

 

আওয়ামী লীগের হাতে নিরাপদআকাশে শান্তির নীড়

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অব্যবস্থপনা থেকে ঘুরে দাড়িয়েছে বাংলাদেশ বিমান। দেখেছে লাভের মুখ। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানের থার্ড টার্মিনাল তৈরির কাজ প্রায় শেষ। নতুন এই টার্মিনালে বিশ্বের ৫৪টি এয়ারলাইন্স তাদের অপারেশন পরিচালনা করবে। সেই সাথে বাড়বে বাংলাদেশ বিমানের ব্যাপ্তি আর ফ্লাইট সংখ্যা। 

 

নতুন ১০টি এয়ারবাস

বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশ বিমানের বহরে যোগ হয়েছে নতুন অনেক বিমান। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নতুন উড়োজাহাজ ড্রিমলাইনারসহ বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যা এখন ২১টি। তার মধ্যে ১৪টি নিজস্ব এবং ৫টি লিজ। নিজস্ব ১৪টির মধ্যে বোয়িং৭৭৭৩০০ ইআর ৪টি, বোয়িং ৭৮৭ ৪টি, বোয়িং ৭৮৭ ২টি, বোয়িং ৭৩৭ ২টি এবং ড্যাশ ২টি।

 

ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে বাংলদেশ বিমান তাদের বহরে বিমান সংখ্যা বাড়িয়েছে। সেই উদ্দেশ্যে সম্প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রনের সাথে ১০টি অত্যাধুনিক এয়ারবাস কেনার চুক্তি হয়। এর আগে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানি থেকে কিস্তিতে ১২টি বিমান ক্রয় করেছিল।

 

যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে এয়ারবাসের কাছ থেকে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার প্রক্রিয়া বেশ আগেই শুরু করেছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এতদিন নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। ফ্রান্সের এই নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে এ৩৫০ মডেলের উড়োজাহাজ জিটুজি পদ্ধতিতে কেনা হবে। এর আগে মে লন্ডনে বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের মধ্যে সংক্রান্ত যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষর হয়। পরে জানানো হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে এয়ারবাস থেকে আটটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ কিনবে বিমান। পরবর্তী সময়ে আলোচনা সাপেক্ষে আরও দুটি মালবাহী (কার্গো) উড়োজাহাজ কেনা হবে। 

 

এয়ারলাইন্সে বিমান সংখ্যা কত হওয়া উচিত?

বিশ্বে লাভবান এয়ারলাইন্স পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেই এয়ারলাইন্সের বিমান সংখ্যা যতো বেশি সেই এয়ারলাইন্স ততো বেশি লাভবান। ভারতে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলোতেও সর্বনিম্ন ২০০ এয়ারক্রাফট থাকে, যার বেশিভাগই ভারতের মধ্যে যাত্রীসেবা দেয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠতে যাওয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রয়াত্ত্ব বিমানবহরে বিমানের সংখ্যা মাত্র ২১টি। বিশ্বের প্রায় ৪২টি দেশের সঙ্গে বিমানের আকাশসেবার চুক্তি থাকলেও মাত্র ১৬টি দেশে এখন কার্যক্রম বিদ্যমান। বিমানবহরে নতুন এয়ারক্রাফটগুলো যুক্ত হলে বন্ধ রুটসহ নতুন নতুন রুট চালু হবে।

 

নতুন উড়োজাহাজ সরবরাহে কমপক্ষে দুই বছর লাগবে। উড়োজাহাজ এলে বিমানের নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ হবে। জাপানে নতুন রুট চালু হয়েছে। কানাডায় আরও ফ্লাইট বাড়ানোসহ গুয়াংজু, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি নতুন রুট চালুর সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে নেওয়া হয়েছে। এয়ারবাসের উড়োজাহাজ কেনা সেই পরিকল্পনারই অংশ। আগামী মাসের মধ্যে গুয়াংজু ফ্লাইট চালু হওয়ারও কথা রয়েছে। প্রায় একযুগ যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধ থাকা ফ্লাইট  চালু করতে কোনো বাধা নেই। সিভিল এভিয়েশনের গ্রিন সিগন্যাল পেলে বিমান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লাইট চালু হবে। ধীরে ধীরে বাড়ছে সুশৃঙ্খল পরিকল্পিত ফ্লাইট সংখ্যা, যে কারণে যুগ যুগ ধরে লোকসানের খাতায় নাম লেখানো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লাভের মুখ দেখছে।

 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

সর্বশেষ - মতামত