সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
দেশ নিয়ে এত গর্বিত আমরা, অথচ ঈদে-চাঁদের কেনাকাটা বিদেশের বাজারে করতেই স্বস্তি পাই। কারণ এ সময় আমাদের বাজার অস্বাভাবিক রকম গরম হয়ে ওঠে। মানুষ ঠকতে থাকে বেশি করে।
উন্নত দেশের বাজারব্যবস্থায় ব্যবসায়ীরা যেটা করেন তা হলো, দ্রব্যপ্রতি লাভের হার কমিয়ে বিক্রি বৃদ্ধির কৌশলের মাধ্যমে মোট লাভের পরিমাণ যথাসম্ভব বেশি করার চেষ্টা করেন। এতে ভোক্তাদের মধ্যে একধরনের স্বস্তি কাজ করে। তা ছাড়া বেশি পরিমাণ বিক্রির জন্য উৎপাদন বাড়ানোর ফলে অনেক বেশি লোকের কর্মসংস্থান হয় এবং তাঁদের পরিবারের আয়ও বৃদ্ধি পায়। ফলে তাঁরাও অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে দ্রব্যসামগ্রী বিক্রিতে ধনাত্মক প্রভাবক হিসেবে কাজ করেন। উন্নত দেশের বাজারে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় সেটি হলো, বেশির ভাগ ভোক্তা যে ধরনের দ্রব্যসামগ্রী কেনেন, সেগুলোর দাম তাঁরা বেশি হ্রাস করে রাখেন। ফলে কম আয়ের লোকজনের মধ্যে অসহনীয় ব্যয় বৃদ্ধির হা-হুতাশ কম থাকে।
উন্নত বাজারব্যবস্থায় আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটা হলো ধনী-গরিব প্রায় সবাই উৎসবের সময় অপেক্ষাকৃত কম দামে দ্রব্যসামগ্রী কেনার আশায় থাকেন; যা আমাদের দেশের বাজারব্যবস্থায় সম্পূর্ণ বিপরীত। উন্নত দেশের বাজারব্যবস্থায় পরিবারের খরচ যে খুব কম হয়, তা কিন্তু নয়। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা যে মোট মুনাফা কম অর্জন করেন, তাও না। তবে বড় বড় উৎসবের সময় দ্রব্যমূল্য কম থাকলে সামগ্রিকভাবে সমাজে একটি স্বস্তিদায়ক পরিবেশ বিরাজ করে; যা দেশের অর্থনীতি এবং বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসবের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা ছাড়া উন্নত দেশের বাজারব্যবস্থায় সরকারি সংস্থাগুলোর কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকায় ব্যবসায়ীদের বাজার নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ খুবই সীমিত। প্রতিযোগিতা বেশি থাকায় মুনাফার হার কমাতে বাধ্য হতে হয়, বাজার-সম্পর্কিত তথ্যপ্রবাহ অবাধ থাকায় ভোক্তারা সচেতন থাকে এবং সবকিছুর ওপর ক্রেতাদের বাজারসেবা প্রদানের মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি থাকে।
অথচ প্রতিবছর পবিত্র রমজান শুরুর আগেই দ্রব্যমূল্য অধিকাংশ ক্রেতার জন্য অসহনীয় হয়ে যায়। বেড়ে যায় খাদ্যদ্রব্যসহ সব সামগ্রীর দাম। রমজান মাসে মানুষ তাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশত মুখরোচক খাবার বেশি পরিমাণে খেয়ে থাকে, আর তাই এসব দ্রব্যসামগ্রীর দাম বাড়লে পরিবারের খরচের বোঝা একটু বেশিই ভারী হয়। আর রমজান মাস শেষে ঈদে পরিবার-পরিজন, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং দরিদ্রদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণের কারণে পোশাকাদি এবং অন্যান্য দ্রব্যের দাম বাড়লে পরিবারের মোট ব্যয় অনেকাংশেই বৃদ্ধি পায়; যা মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য ধার করা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না। মূল্যবৃদ্ধি বা মুদ্রাস্ফীতি হলে প্রকৃত আয় আরও কমে যায়, যা সহজেই অনুমেয়।
সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে বর্তমান গড় মুদ্রাস্ফীতির হার ৬ শতাংশের নিচে, তবে উৎসবের সময় তা অনেক বেড়ে যায়। মূল্যবৃদ্ধির কারণ অনেক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই; তবে ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা করার বিষয়টি সবার নজরে আসে। অর্থনীতি বিষয়ের মূল সূত্রের দোহাই দিয়ে উৎসব মৌসুমে চাহিদা বাড়লে মূল্য বাড়বে—এটাকেই বাস্তবে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে মূল্য বৃদ্ধি করার কৌশলটি যে আদর্শ কোনো কৌশল নয়, তা উন্নত দেশের বাজারব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি।
তবে আমাদের মতো দেশে ব্যবসায়ীদের ব্যবসার ঝুঁকি এবং তাঁদের পুঁজির নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারের বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ তাঁরা তাঁদের ব্যবসায় প্রচুর বিনিয়োগ করে থাকেন, যার বড় ধরনের ঝুঁকি এবং নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে তাঁরা সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকেন। ফলে সেটা পুষিয়ে নেওয়ার একটি তাড়না তাঁদের মধ্যে কাজ করবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। উন্নত দেশে ব্যবসার ঝুঁকি এবং নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি আমাদের দেশের তুলনায় নেই বললেই চলে। আমাদের এও মনে রাখতে হবে, আমাদের সব ব্যবসায়ী যে অত্যধিক ধনী, বড় ধরনের ঝুঁকি গ্রহণে সামর্থ্যবান বা সমাজের প্রতি সমানভাবে দায়িত্বশীল মনোভাবাপন্ন, তা কিন্তু নয়।
এটি গর্বের বিষয় যে আমাদের দেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। ২০২৪ সালে আমাদের দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছি। আমরা কি পারি না এখনই কিছু পরিবর্তন আনার, যাতে সমাজে স্বস্তি আসে এবং অর্থনীতিতে আরও বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করার সম্ভাবনা তৈরি হয়? ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এবং বাজারব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে অর্থনীতিতে দ্রুত পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে মনে হয়। ইদানীং আরও একটি বিষয়ও লক্ষণীয় তা হলো, উৎসবের সময় দ্রব্যমূল্য বেশি থাকলে যাঁদের সামর্থ্য আছে তাঁরা বিকল্প হিসেবে ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য পার্শ্ববর্তী দেশে বাজার করতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন; যার কুফল দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের অর্থনীতিতে পড়বে। অনেকেই হয়তো স্বীকার করবেন, স্বাস্থ্যসেবায় এর প্রভাব ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হয়েছে।
প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে বহুজাতিক অনেক কোম্পানি আমাদের বাজার দখলের চেষ্টা করছে, সেদিকেও আমাদের সম্মানিত ব্যবসায়ীদের নজর রাখতে হবে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ আশা করে সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় সচেতন ব্যবসায়ী সমাজ ও নীতিনির্ধারকেরা দ্রুত বস্তুনিষ্ঠ চিন্তাভাবনা নিয়ে এগিয়ে এসে ধনাত্মক বা সমাজের জন্য কল্যাণকর পরিবর্তন আনার ব্যবস্থা করবেন এবং আমরা পর্যায়ক্রমে নিম্ন মুদ্রাস্ফীতির দিকে ধাবিত হব, আমাদের বাজারব্যবস্থা এবং অর্থনীতি হবে স্থিতিশীল। তাতে ক্রেতা-বিক্রেতার স্বার্থ বিপরীতমুখী হলেও ধীরে ধীরে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা ও আস্থার পরিবেশ তৈরি হবে।