ইয়াজেনের আটকের ঘটনাকে ‘প্রশাসনিক কারণে আটক’ বলা হয়েছিল, যেটি মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কাউকে আটকের সময় ব্যবহার করে থাকে ইসরায়েল।
এটি পুরনো একটি ব্রিটিশ আইন, যেটি উত্তরাধিকার সূত্রে দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা নীতি হিসেবে নিয়েছে ইসরায়েল। এই আইনের অধীনে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই একজন ব্যক্তিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাবন্দি করে রাখা যায়।
ইয়াজেন বিবিসিকে বলে, তাদের কাছে একটি গোপন ফাইল রয়েছে। কিন্তু তারা আপনাকে বলবে না সেটিতে কী আছে।
৭ অক্টোবর হঠাৎ হামলা চালিয়ে হামাস যে ইসরায়েলি নাগরিকদের জিম্মি করেছিল, তাদের ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে কিছুদিন আগে ১৮০ ফিলিস্তিনি শিশু ও নারীকে মুক্তি দেয় ইসরায়েল।
ওই নারী ও শিশুকে দিনের পর দিন বিনা অপরাধে ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছিল। এমন এক সময়ে তাদের মুক্তি দেওয়া হলো, যখন অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে ইসরায়েল।
৭ অক্টোবরের পর থেকে অন্তত ১ হাজার ৩০০ ফিলিস্তিনিকে ‘প্রশাসনিক কারণে আটক’ আটক করা হয়েছে, যা গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে এ আইনের আওতায় দুই হাজার আটশরও বেশি ফিলিস্তিনি এখন ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
ইয়াজেনকে যখন মুক্তি দেওয়া হয়, তখন তার পরিবারকে সতর্ক করা হয়েছিল এই বলে যে, তারা যেন কোনোভাবেই প্রকাশ্যে কোন উদযাপন না করে বা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলে।
একই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল আরও দুই কিশোরের পরিবারকে, যারা বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছে। তারা হলো ১৬ বছর বয়সী ওসামা মারমেশ, ১৭ বছর বয়সী মুসা অ্যালোরিদাত।
ইসরায়েল বলেছে, এ আইনের ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রয়োজনীয় একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সামরিক বিচার ব্যবস্থার সাবেক পরিচালক মরিস হিরশ বিবিসিকে বলেন, আটক ফিলিস্তিনিদের আপিলের সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি প্রতি ছয় মাস পর পর তাদের বন্দি দশার বিষয়টি পর্যালোচনা করার মাধ্যমে ইসরায়েল কেবল আন্তর্জাতিক আইনই মানছে- তা নয়, বরং সেটিকে ছাড়িয়েও গেছে।
তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ইসরায়েল যেভাবে আইনটির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের আটক করছে, সেটি আসলে অপব্যবহারে পর্যায়ে চলে গেছে। তা ছাড়া আটক হওয়া ব্যক্তিরা নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণ বা কার্যকরভাবে আপিল করার সুযোগ খুব একটা পান না।
কারণ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য যে ধরনের তথ্য-প্রমাণ দরকার হয়, তা সংগ্রহ করার অনুমতি তাদের নেই।
বন্দিদের পর্যবেক্ষণকারী ইসরায়েলের মানবাধিকার সংস্থা হ্যামোকেডের নির্বাহী পরিচালক জেসিকা মন্টেল বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ‘প্রশাসনিক কারণে আটক’ একটি বিরল ব্যতিক্রম হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, আপনার কেবল তখনই এটি ব্যবহার করা উচিত, যখন আপনি চরম বিপদ থাকবেন এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করা ছাড়া সেই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্য কোন উপায় নেই। কিন্তু এটি স্পষ্ট যে, ইসরায়েল এ আইনকে সেভাবে ব্যবহার করছে না। তারা হাজার হাজার মানুষকে বিনা অভিযোগে আটক করছে এবং নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রশাসনিক কারণে আটকের কথা বলছে।
ফিলিস্তিনিরা ১৯৪৫ সাল থেকেই প্রশাসনিক কারণে আটক আইনের ভুক্তভোগী। প্রথমে ব্রিটিশদের অধীনে এবং পরে অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে।
অতীতে আইনটি খুব বিরল কিছু ক্ষেত্রে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এখন এটি শিশুসহ পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের আটক করার ক্ষেত্রেই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রশাসনিক বন্দি শুনানির অনুমতি দেওয়া হয় সামরিক আদালতে, একজন ইসরায়েলি সামরিক বিচারকের সামনে। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আটককৃত ব্যক্তি বা তাদের আইনজীবীদের কাছে আটকের পক্ষে কোন তথ্য-প্রমাণ প্রকাশ করার প্রয়োজন হয় না। এরপর আটক হওয়া ব্যক্তিদের ছয় মাস পর্যন্ত সাজা হতে পারে।
তবে সামরিক আদালত চাইলে এই ছয় মাসের সাজা অনির্দিষ্টকালের জন্যও বাড়াতে পারে। অর্থাৎ এই আইনে বন্দি হওয়া ব্যক্তিরা ঠিক জানেনও না যে, তারা কতদিন বন্দি থাকবেন।
বন্দিরা ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত আপিল করতে পারে, কিন্তু তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের বা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণের কোন অনুমতি নেই।
ফলে ইসরায়েলি সামরিক আদালতে বিচার হওয়া এমন ফিলিস্তিনিদের মধ্যে মোটামুটি ৯৯ শতাংশই দোষী সাব্যস্ত হন।
জেরুজালেম-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা আইনজীবী মাহের হান্না বিবিসিকে বলেন, সামরিক আদালতে ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। পুরো ব্যবস্থাটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যা একজন ফিলিস্তিনির আত্মরক্ষার ক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছে। এটি প্রতিপক্ষকে একদিকে যেমন কঠোর সীমাবদ্ধতার মধ্যে ফেলে দেয়, তেমনি রাষ্ট্রপক্ষকেও প্রমাণ সংগ্রহ করার ঝামেলা থেকে মুক্তি দেয়।
ওসামা মারমেশ বিবিসিকে বলছিল যে, যখন তাকে আটক করা হয়েছিল, তখন তাকে রাস্তা থেকে টেনে হেঁচড়ে একটি নম্বরবিহীন গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
ওসামাকে আটকের প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার বাবা নায়েফের কোনো ধারণাই ছিল না যে, তার ছেলে কোথায়? তিনি বলেন, আপনি আপনার পরিচিত সবাইকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করুন যে তারা আপনার ছেলেকে দেখেছে কি-না। আপনার চোখে ঘুম নাই।
আটক হওয়ার সময় ওসামা তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ব্যাপারে বারবার জিজ্ঞেস করেছিল। এর জবাবে তাকে প্রতিবারই “চুপ” করতে বলা হয়েছিল।
অন্যদিকে মুসা অ্যালোরিদাতকে যখন আটক করা হয়েছিল, ইসরায়েলি সৈন্যরা তার অন্য দুই ছোট ভাইকে আলাদা করে ফেলে এবং ঘরে থাকা একটি ওয়ারড্রোবে গুলি করে কাচ ভেঙে ফেলে। মুসার বাবা মুহান্নাদ বলেন, তিন দিন পর্যন্ত আমরা কিছুই জানতাম না।
বন্দি থাকা অবস্থায় ইয়াজেন, ওসামা, মুসা, তাদের বাবা-মা কিংবা আইনজীবী- কাউকেই আটকের স্বপক্ষে কোন প্রমাণ দেখানো হয়নি।
ইয়াজেন, ওসামা এবং মুসাকে চার থেকে সাত মাস ইসরায়েলি কারাগারে কাটাতে হয়েছে।
তারা তিনজনই বলেছিল যে, গত ৭ অক্টোবরের আগে পর্যন্ত পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। কিন্তু এরপর হামাসের হামলার শাস্তি হিসেবে তাদের বিছানার চাদর, কম্বল, জামা-কাপড় এবং খাবারের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বহির্বিশ্বের সাথেও সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
আটক হওয়া অন্য কয়েক জন ব্যক্তি আরও অভিযোগ তুলেছেন যে, ধরে নেওয়ার পর তাদেরকে মারধর করা হয়েছে, টিয়ারগ্যাস ছোড়া হয়েছে, এমন কি তাদের ওপর কুকুরও লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলি কারা কর্তৃপক্ষ অবশ্য এটা নিশ্চিত করেছে যে, হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় তারা কারাগারগুলোতে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন এবং সেখানে নিরাপত্তা বন্দিদের সুবিধা সীমিত করা হয়েছিল।