সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক
এক সময় যক্ষ্মা রোগ শনাক্তকরণ এবং আক্রান্তদের চিকিৎসা শহরকেন্দ্রিক হলেও বর্তমানে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছেছে এই সেবা। এর ফলে গত এক বছরে দেশে যক্ষ্মা শনাক্তের হার বেড়েছে। এ ছাড়া উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে মিলছে যক্ষ্মার সর্বোচ্চ চিকিৎসা। এই চিকিৎসার ৯৫ শতাংশই সফল হচ্ছে। তার পরও যক্ষ্মা সংক্রমণে বিশ্বের উচ্চঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কৌশলপত্র অনুযায়ী, আগামী বছরের মধ্যে যক্ষ্মায় মৃত্যু ১৮ হাজারে নামিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে শনাক্তের হার কমাতে হবে ৫০ শতাংশ। ফলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে রবিবার (২৪ মার্চ) বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে— ‘হ্যাঁ, আমরা যক্ষ্মা নির্মূল করতে পারি।’ দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাফল্য উল্লেখ করার মতো। তবে পুরনো সমস্যা সমাধানে মানুষের সচেতনতার পাশাপাশি সরকারের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। শনাক্ত বাড়লেও এর প্রক্রিয়াতে ঘাটতি রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের যক্ষ্মা চিকিৎসায় সফলতার হার প্রশংসারযোগ্য হলেও সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা শিশুদের যক্ষ্মায়। স্থানীয় পর্যায়ে শিশুদের যক্ষ্মা নির্ণয়ে এখনো কাক্সিক্ষত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। এটি ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের হার ৯৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। এর মধ্যে মারা যান ১৩ লাখ। তবে গত চব্বিশ বছরে চিকিৎসা নিয়ে যক্ষ্মা থেকে ফিরে আসা রোগী সাড়ে ৭ কোটি। সংস্থাটির তথ্যমতে, বর্তমানে যক্ষ্মা সংক্রমণের দিক থেকে বিশে^র সর্বোচ্চ ৩০ দেশের একটি বাংলাদেশ। দেশে এখন প্রতি লাখে মারা যায় ২২১ জন, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের আগে রয়েছে একমাত্র আফগানিস্তান।
রাজধানীর শ্যামলীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটিতে ২০২২ সালে বহির্বিভাগে ৮১ হাজার ২৮১ জন যক্ষ্মা রোগী চিকিৎসা নেয়। এর মধ্যে ভর্তি রোগী ছিলেন ২ হাজার ৮৯০ জন। গত বছর (২০২৩) এ সংখ্যা ২৩ হাজারেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৪ হাজার ৫৫৪ জনে দাঁড়ায়। অন্যদিকে ২০২২ সালে এ হাসপাতালে যক্ষ্মায় মারা গেছেন ৬২ জন, গত বছর মারা গেছেন ৬৩ জন।
প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, ‘২০১৫ সালের আগে চিকিৎসার আওতায় খুব বেশি মানুষ ছিল না, এখন সেই চিত্র পরিবর্তন হয়েছে। গত বছর থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও জিন-এক্সপার্ট মেশিন পৌঁছেছে। ফলে পরীক্ষা বাড়ায় রোগী বাড়ছে। বেসরকারি পর্যায়ে এসব পরীক্ষা করতে চার-পাঁচ হাজার টাকা লাগে, সেখানে বিনামূল্যে দিচ্ছে সরকার। তবে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে সময় লাগবে। যে গতিতে এগোচ্ছে তাতে চ্যালেঞ্জের হলেও অসম্ভব না।’
ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে— মানুষ ঠিকমতো ওষুধ খায় না। অনেকে মাঝপথে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেয়। এতে করে অ্যান্টিাবায়োটিক রেজিসটেন্স বাড়ছে। কাজেই সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, সবার সহযোগিতা লাগবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, প্রায় এক দশক আগে ২০১৫ সালে শনাক্ত রোগী ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ৪৩৮ জন এবং শনাক্তের হার ছিল ৫৮ শতাংশ। তবে পরবর্তী সময়ে সুযোগ-সুবিধা বাড়ায় শনাক্ত রোগী বেড়েছে। ২০২৩ সালে যক্ষ্মারোগী শনাক্ত রোগী বৃদ্ধি পেয়ে ৩ লাখ ১ হাজার ৫৬৪ জন বা ৮০ শতাংশে ওঠে। অর্থাৎ এই শনাক্তের হার প্রায় ২২ শতাংশ বেড়েছে। তবে শনাক্তের হার বাড়লেও একই সময়ে মৃত্যুর হার কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। ২০১৫ সালে প্রতি লাখে ৪৫ জন মারা গেলেও বর্তমানে ২৫ জনে নেমে এসেছে।
২০৩৫ সালের মধ্যে আক্রান্তের হার ৯০ শতাংশ এবং মৃত্যুহার ৯৫ শতাংশ কমিয়ে আনার নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে সরকারি ৪৪টি বক্ষব্যাধি ক্লিনিক, সাতটি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়াও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে সরকারের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি।
এই কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. মাহফুজুর রহমান সরকার বলেন, ‘অতীতের তুলনায় বর্তমানে ডায়াগনসিস সুযোগ-সুবিধা ভালো হওয়ায় শনাক্তের হার বেড়েছে। এটা আমাদের জন্য ইতিবাচক। এটি সরকারি-বেসরকারি বড় হাসপাতালগুলোর তথ্য। বর্তমানে সরকারির পাশাপাশি বেসরকারিতেও সরকার ওষুধ দিচ্ছে। তার পরও আমরা এখনো সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায়। এর থেকে বের হতে হলে মানুষের সচেতনতায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’
ডা. মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনো নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পিছিয়ে থাকার কারণ মানুষের মাঝে সচেতনতার ঘাটতি। অন্যান্য রোগের সঙ্গে থাকায় এটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সচেতনতার জায়গাটা বাড়ানো গেলে পরিস্থিতির আরও উন্নতি সম্ভব। তবে ক্রমেই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এক সময় যক্ষ্মার ওষুধ বিদেশ থেকে আনা হতো, ২০১৭ সালে সরকার বিনামূল্যে দিচ্ছে। একেবারে নির্মূল করতে হলে এটাকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে নিতে হবে।’
এদিকে আক্রান্ত রোগীরা নিয়মিত ওষুধ না খাওয়ায় বাড়ছে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ¥ রোগীর সংখ্যা। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ২০২১ সালে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা হয়েছে সাড়ে ৪ লাখ মানুষের। এর মধ্যে মাত্র ৩৬ শতাংশকে চিকিৎসা দেওয়া গেছে। বাংলাদেশে এই চিত্র আরও ভয়াবহ।
বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের প্রধান সমস্যা নির্ণয়ে। বর্তমানে যেসব রোগীর তথ্য আমরা পাচ্ছি, তাতে বেসরকারির তথ্য খুব একটা নেই। কিন্তু বড় অংশ যাচ্ছে সেখানে। ফলে এসব রোগী হিসেবের বাইরে থাকছে। এতে করে পুরো চিত্র উঠে আসছে না। তবে আশার কথা হলো, বর্তমানে সুযোগ-সুবিধা বাড়ায় সরকারি হাসপাতালে রোগীদের ভিড় বাড়ছে। এতে করে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকটা সহজ হবে।