হাসান মোঃ শামসুদ্দীন :
মিয়ানমার জুড়ে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশটির অন্যান্য প্রতিবেশীর মত বাংলাদেশও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি (এ এ) ও মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বি জি পি) মধ্যেকার আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের পর বাংলাদেশ – মিয়ানমার সীমান্তের কিছু কিছু চৌকি এ এ নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সেখান থেকে বি জি পির সদস্যরা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুন অনুসারে তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরার ব্যবস্থা করছে।
১১ মার্চ সীমান্তপথে বিজিপির ১৭৯ সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, এর আগে আশ্রয় নেয়া ৩৩০ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। আপাতদৃষ্টিতে এই সব এলাকা এ এ’র নিয়ন্ত্রণে থাকলে ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী সহজে সীমান্ত নিরাপত্তা হাতছাড়া করবে না, ফলে সামনের দিনগুলোতে এসব এলাকায় সেনাবাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালাবে। এর ফলে সংকট দীর্ঘায়িত হবে এবং এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলির কারনে সেখানে হতাহতের ঘটনা ঘটছে এবং সীমান্ত এলাকার মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের চলমান সংকট নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। মিয়ানমারের এই সংকটের কারনে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে এবং এর পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্ত নিরাপত্তাসহ নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
বর্তমানে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধরত পক্ষগুলো সবাই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও ফেডারেল কাঠামোর অধীনে ঐক্যবদ্ধ মিয়ানমার রাষ্ট্রের পক্ষে। তারা নিজেদের মধ্যেকার মতভেদ মিটিয়ে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলে কিংবা অন্য যে কোন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি যাতে গুরুত্ব পায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। বহিঃশক্তির প্রভাবের কারনে মিয়ানমারের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশকেও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে হবে। মিয়ানমারের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলোতে এই প্রথমবারের মত জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো (ই এ ও) তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করতে একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একত্র হয়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ চালাচ্ছে। সামরিক জান্তাবিরোধী সংগঠনগুলো একত্র হওয়ায় মিয়ানমারের ইতিহাসে বর্তমান সংঘাত অভূতপূর্ব তীব্রতা লাভ করেছে। এই সংঘর্ষের ধাক্কা আমাদের সীমান্তেও আসছে এবং সে কারনে বাংলাদেশকে নানাবিধ সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে। তাই রাখাইনের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রথম ও প্রধান করনীয় হলো দ্রুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ মিয়ানমারে এমন পরিস্থিতি আশা করে যেখানে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সফল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব।
এ এ রাখাইনের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। দীর্ঘ সময় ধরে এ এ রাখাইনে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও তা সংহত করতে কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে তাদের নিজভূমে ফিরে যেতে হবে। তা নিশ্চিত করতে যে কোন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং এ এ আর্মিকে বিবেচনায় রাখতে হবে। চীন ও ভারতের মতো আরাকান আর্মির সঙ্গে যে কোন উপায়ে বাংলাদেশের যোগাযোগ থাকা উচিত।
বিদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ মিয়ানমারের বাহিরে থাকা রাখাইনের বুদ্ধিজীবী ও রাখাইনের প্রধান রাজনৈতিক দল ইউ নাইটেড লীগ অব আরাকানের (ইউ এল এ) নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে সম্পর্ক উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হবে। গত সাত বছরের এ বিষয়ে তেমন কোন অগ্রগতির তথ্য জানা যায় নাই। রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইনেই ফিরে যেতেই হবে এবং সেখানে রাখাইন জনগোষ্ঠীর সাথেই তাদেরকে শান্তিপূর্ণ সহবস্থান করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিয়োজিত সব পক্ষকে এ এ’র সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তার বিষয়ে কাজ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন ও রাখাইনদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহবস্থান নিশ্চিত করতে এই ধরনের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ।
চলমান পরিস্থিতিতে বিদ্রোহীদের ঐক্যজোট ব্রাদার হুড এলায়েন্স সরকারের পতন ঘটাতে পারলে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে আশা করা যায়। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা গেলে জাতীয় ঐক্যের সরকার (এন ইউ জি) বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব এবং অন্যান্য অধিকার ও সুবিধা দিয়ে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেবে বলে জানায়। রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃবৃন্দ এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে নিয়োজিত সব পক্ষকে এ এ এবং এন ইউ জি’র সাথে যোগাযোগ স্থাপন ও তা নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। মিয়ানমারের বিশেষত আরাকানের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে রোহিঙ্গাদের জন্য সেখানে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে দুটি বিষয়ের দিকে নজর রাখতে হবে। প্রথমত, মিয়ানমারের অস্থিতিশীল আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ সীমান্তে এর প্রভাব নিয়ন্ত্রণ। একই সাথে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও অস্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘ মেয়াদে এই সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেয়া।
এ এ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের কারনে মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল ও গুলি বাংলাদেশের ভেতরে পড়ছে। এর ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের মানুষ আতংকে রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এসব চৌকি দখলের উদ্যোগ নিলে পুনরায় সংঘর্ষের সুচনা হতে পারে এবং সীমান্ত এলাকার শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে, তাদের ব্যবহার করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ এ এ দখল করে নিচ্ছে। এই সব অস্ত্রের সঠিক সংখ্যা ও কোথায় যাচ্ছে তা জানা সবসময় সম্ভব নয়। বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতেও অবৈধ পথে এই অস্ত্র আসতে পারে, এর ফলে ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে আসলে পুরো পার্বত্য এলাকায় আবার অশান্তি ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে। মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সংকটের কারনে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর মানুষ সংকটে রয়েছে। এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে এবং কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার সরকারের সাথে যোগাযোগ পূর্বক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
এ এ এবং রাখাইনের জনগণের সাথে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলাদেশকে মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন এলাকা সম্পর্কে ধারনা বাড়ানোর কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে। বার্মিজ ভাষায় দক্ষ জনবল তৈরি করে তাদেরকে মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এবং সীমান্তের কাছাকাছি এলাকার জনগণ ও অন্যান্য বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ জোরদার করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সীমান্ত নজরদারি কিছুটা শিথিল থাকায় এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে এখন এ এ অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক ভাবে আরাকান আর্মি বা এন ইউ জির সাথে সম্পর্ক স্থাপন বা যোগাযোগ করতে পারে না তবে বিভিন্নভাবে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। এজন্য একটা মজবুত প্লাটফর্ম গঠন করতে হবে যাতে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব যেমন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রশাসন, নিরাপত্তা, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, গবেষক, সুশীলসমাজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তারা এই সংকট উত্তরণে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং অন্যান্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংস্থার সাথে যোগাযোগ পূর্বক সমস্যা সমাধানে অগ্রগতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ পূর্বক তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা তহবিল কমছে। রোহিঙ্গা সংকট চলমান প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মনোযোগের আড়ালে চলে গেছে, বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থে এই সংকট যেন গুরুত্ব না হারায় সেজন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বিশ্বের নানা প্রান্তে সমস্যা মোকাবেলায় তহবিল–সংকট থাকায় বরাদ্ধ কমে আসছে। ২০২৪ সালের জে আর পি তে ৮৫ কোটি ২৪ লাখ ডলার চাওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য ৮৭ কোটি মার্কিন ডলার চাহিদার বিপরীতে ৫০ শতাংশ বরাদ্ধ পাওয়া গিয়েছিল। সহায়তা তহবিল কমে আসায় রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং এর ফলে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে। খাদ্যসহায়তা কমে গেলে রোহিঙ্গারা আরও মরিয়া হয়ে উঠবে, যা ক্যাম্পগুলোতে সহিংসতা ও অস্থিরতা বাড়াবে বলে মনে করে জাতিসংঘ। বাংলাদেশকে এর মোকাবেলায় এখন মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। একই সাথে সংকট সমাধানের একটা রোড ম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে। যে কোন জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সম্ভাব্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
মিয়ানমারের সংঘাত নিরসনে আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে একত্রে শান্তি আলোচনায় যোগ দিয়ে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। আসিয়ান দেশগুলোর সাথে একত্রে আমাদের সমস্যাগুলো সমাধানে তৎপর হতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে চীন, ভারত, থাইল্যান্ডও মিয়ানমারের সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত তাই এই দেশগুলোর সাথে একত্রে করনীয় ঠিক করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট যেন বিশ্ব ভুলে না যায় সেজন্য সচতনতা ও এর অগ্রগতি নিয়মিতভাবে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশী ক্ষতির সম্মুখীন তাই এই সমস্যা সমাধানে সকল পক্ষকে নিয়ে আমাদেরকেই অগ্রণী ভুমিকা পালন করতে হবে।