সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বায়োমেট্রিক মেশিন বাধ্যতামূলক ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এই নির্দেশের ৯ মাস পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) বায়োমেট্রিক মেশিন বসানো হয়নি। এর সুযোগ নিচ্ছেন চিকিৎসকদের কেউ কেউ। অভিযোগ আছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক চিকিৎসকই হাসপাতালের ডিউটি ফাঁকি দিয়ে বাইরে গিয়ে মাসের পর মাস প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন। নাম প্রকাশ না করে বিএসএমএমইউ’র একাধিক চিকিৎসক বলেন, ফাঁকিবাজ চিকিৎসকদের হাজিরা নিশ্চিত করতে বায়োমেট্রিক মেশিন বসানো জরুরি।
বিএসএমএমইউ’র অফথালমোলজি বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মোহাম্মদ চৌধুরী আনোয়ার। যে সময় তার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে থাকার কথা, রোগী দেখার কথা, সে সময়ে তিনি রোগী দেখেন মোহাম্মদপুরের অ্যাডভান্সড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। অভিযোগ আছে, ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার সপ্তাহের ছয় দিনই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। এর মধ্যে পাঁচ দিন বসেন মোহাম্মদপুরের ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে, আর প্রতি বুধবার রোগী দেখেন গাজীপুরের আরেকটি চেম্বারে।
মোহাম্মদপুরের অ্যাডভান্সড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেলিফোন করে রোগী সেজে চৌধুরী আনোয়ারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলে রিসিপশন থেকে নাজমুল নামের একজন ২ জানুয়ারি দুপুর একটা থেকে দেড়টার মধ্যে যেতে বলেন। তবে ডা. মোহাম্মদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
ডা. আনোয়ারের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এধরনের তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অফথালমোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ডা. মোহাম্মদ চৌধুরী আনোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর গত ২১ ডিসেম্বর তদন্ত কমিটি গঠন করেছি, তারা কাজ করছেন। তদন্ত কমিটিকে দুই সপ্তাহের ভেতরে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
তবে একাধিক সূত্রের দাবি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে রোগীর তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি! কিন্তু চিকিৎসকরা ঠিকমতো হাসপাতালে আসেন না। কেবল ডা. আনোয়ারই নয়, হাসপাতাল চলাকালীন অন্য চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও নিজস্ব চেম্বারে রোগী দেখার অভিযোগ রয়েছে।
চলতি বছরের ২ এপ্রিল সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বায়োমেট্রিক মেশিনের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্দেশনাটি ছিল সরকারি হাসপাতালের জন্য, তারপরও দেশের অন্যতম এই মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে দায় এড়াতে পারে না। সরকারি নিয়ম বিএসএমএমইউ’র জন্য প্রযোজ্য না হলেও নৈতিক দিক বিবেচনা করে হলেও এ হাসপাতালে চিকিৎসকদের হাজিরা নিশ্চিত করতে বায়োমেট্রিক মেশিন বসানো জরুরি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এবিষয়ে একেবারেই উদাসীন। এরই সুযোগ নিচ্ছেন এক শ্রেণির চিকিৎসক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক মেশিন নেই। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও এই হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সবার বেতন-বোনাস, ইউজার ফি সবকিছু সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ও সরকারি মানদণ্ডে করা হয়। যেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এরকম একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে, সেখানে এই হাসপাতাল কেন সরকারের নির্দেশ অনুসরণ করবে না।
কর্মস্থলে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি ঠেকাতেই বায়োমেট্রিক মেশিন বসানোর নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নিয়েছে, এমন প্রশ্ন তোলেন তারা। চিকিৎসকরা বলছেন, মাঝে মাঝেই গণমাধ্যমে সংবাদ হচ্ছে—এই হাসপাতালের চিকিৎসকরা হাসপাতালে আসছেন না, তারা হাসপাতাল চলাকালে বিভিন্ন জায়গায় প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন।
বায়োমেট্রিক মেশিন না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালেরই একাধিক চিকিৎসক এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন, যখন তাদের হাসপাতালে রোগী দেখার কথা, তখন তারা থাকছেন বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে। আর এটা সম্ভব হয়েছে কেবল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনও নজরদারি না থাকার কারেণ।
চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ারের বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘ফেসবুকে ডা. আনোয়ারের বিষয়টি দেখতে পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে আমরা তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি করেছি, তাদের দুই সপ্তাহের ভেতরে এর রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে এবং সত্যতা পেলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ হাসপাতালের এমন অনেক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অফিস আওয়ারে হাসপাতালে না এসে বাইরে প্র্যাকটিস করার অভিযোগ রয়েছে, এমন প্রশ্নে উপাচার্য বলেন, ‘অভিযোগ এলে আমরা তদন্ত করবো এবং সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বায়োমেট্রিক মেশিন প্রয়োজন কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন,‘এখানে বায়োমেট্রিক মেশিন নেই। তবে প্রতিটি বিভাগে হাজিরা খাতা রয়েছে। সেখানেই চিকিৎসকরা হাজিরা দেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাজিরার জন্য বায়োমেট্রিক মেশিন চালুর বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।’
বিএসএমএমইউ’র সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘এখন আর নৈতিকতা ‘ওয়ার্ক’ করে না, যদি না সেটা আইনের আওতায় না হয়।’