সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
সেদিন আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে তরুণ সাংবাদিক সামছুর রহমান একটি কথা বলে সবাইকে চমকে দিলেন। তিনি প্রথম আলোর স্টাফ রিপোর্টার। আলোচনা হচ্ছিল প্যালিয়েটিভ কেয়ার, অর্থাৎ প্রশমনসেবায় তরুণদের সম্পৃক্তির বিষয়ে। কঠিন কোনো অসুখ বা শুধু বয়সের ভারে রুগ্ণ হয়ে শেষ দিনগুলো কাটাচ্ছেন, এমন ব্যক্তিদের জন্য এ ধরনের সেবা খুব দরকার। আলোচকদের তালিকায় সামছুর রহমানের নাম ছিল না। কিন্তু তিনি শুধু তাঁর একটি অভিজ্ঞতা বলার অনুমতি চাইলেন। তিনি বললেন, বছর দশেক আগে তাঁর বাবা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এরপর থেকে তাঁর ডান পা, ডান হাত অবশ। জীবন প্রায় অচল। কিন্তু প্রতিদিন যখন সামছুর রহমান পাঁচ-দশ মিনিটের জন্য তাঁর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, বলেন, ‘বাবা, আমি তোমার পাশে আছি, ’ তখন তাঁর বাবা যেন নতুন জীবন ফিরে পান। এক পরম প্রশান্তি লাভ করেন। তিনি কিছুক্ষণের জন্য সব কষ্ট-বেদনা ভুলে যান। বাকি দিনটা তাঁর আনন্দে কাটে।
রবিঠাকুরের গানের কলি মনে পড়ল। ‘অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ…।’ এই অসাধ্যসাধন করতে পারেন তরুণেরা। তাই প্যালিয়েটিভ কেয়ারে তরুণদের সম্পৃক্তির ওপর এখন গুরুত্ব দিচ্ছেন সবাই। আয়াত এডুকেশন সেই কাজটিই করছে। গোলটেবিল বৈঠকে সহযোগিতায় ছিল বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠান। ওরা প্রধানত নীতি সংলাপ, জনসচেতনতা সৃষ্টি, তরুণদের সক্রিয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা, স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলে তাঁদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কাজ করছে।
সেদিন আমাদের গোলটেবিল বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্যালিয়েটিভ কেয়ার সম্পর্কে তরুণদের সচেতন করা। তাঁদের মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করা। আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি তো সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তরুণদের এই সেবার কাজে সম্পৃক্ত করার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্যালিয়েটিভ কেয়ারের জন্য বাজেটে বিশেষ ব্যবস্থা রাখার গুরুত্বের কথাও তিনি বললেন।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল কলেজ, বোস্টনের এমজিএইচ বিমলাংশু রঞ্জন দে আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, প্যালিয়েটিভ কেয়ারের মূল একটি বিষয় হলো রোগীর সঙ্গে কথা বলা। আসলে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের প্রধান ব্যক্তি, যাঁর অঙ্গুলিহেলনে এত দিন সংসার চলেছে, তিনি যদি দেখেন শুধু বয়সের কারণে তাঁকে সংসারের ডাস্টবিনে ফেলে রাখা হয়েছে, কেউ তাঁর কথায় পাত্তা দেয় না, তখন তাঁর মনের অবস্থা কী হবে ভেবে দেখুন তো?
তবে শুধু কথা বলা আর কাছে বসে একটু সময় দেওয়াই যথেষ্ট নয়। কিছু চিকিৎসা, ওষুধপথ্যও দরকার। এ জন্য হাসপাতালে প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিট থাকতে হবে। বাসায় চিকিৎসাসেবার সুযোগ রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন আহমেদ সে কথাটি মনে করিয়ে দিলেন। অনেকে শেষ বয়সে ক্যানসার বা অন্য কোনো অসুখে ভীষণ কষ্ট পান। তাঁর ব্যথা–বেদনা কমানোর জন্য চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দরকার। তাহলে রোগী হয়তো শেষ বয়সটা আরামে কাটাতে পারবেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন লায়লা করিম। তিনি আয়াত এডুকেশনের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) স্বাস্থ্যবিষয়ক ধারা-উপধারাগুলো বাস্তবায়নের জন্যও প্যালিয়েটিভ কেয়ার কার্যক্রমে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণের বিশেষ গুরুত্বের কথা তিনি বলেন।
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, কোনো প্রাণীর স্বাভাবিক আয়ু তার শারীরিক গঠনের প্রবৃদ্ধির সময়কালের (গ্রোথ পিরিয়ড) ৬ গুণ। সেই হিসাবে মানুষের গ্রোথ পিরিয়ড ২৫ ধরলে তার স্বাভাবিক আয়ু ১৫০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু এর আগেই ক্যানসার, হার্টের সমস্যা বা অন্য কোনো কঠিন রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করতে হয়। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এখন চেষ্টা করছেন বার্ধক্য কতটা বিলম্বিত করা যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহকোষগুলো অকার্যকর হতে শুরু করে। তাই এখন পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছে, কীভাবে এই ক্ষয়িষ্ণু দেহকোষগুলো সারিয়ে তোলা যায় এবং নতুন দেহকোষ সৃষ্টি করা যায়। কিছু অগ্রগতিও আছে। যদি এটা সম্ভব হয়, তাহলে হয়তো বয়স বাড়লেও বার্ধক্য আসবে দেরিতে। ভোগান্তি কম হবে। কিন্তু প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রয়োজনীয়তা থেকেই যাবে।
আমরা চাই শুধু তরুণেরা নয়, এলাকার সবাই মিলে প্যালিয়েটিভ কেয়ারে সম্পৃক্ত হোক। যাকে বলে কমিউনিটি স্তরে সচেতনতা। তরুণেরা সেখানে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারেন।
ক্যানসারের চিকিৎসাও এখন অনেক উন্নত। তারপরও, কোনো কোনো ক্যানসার নিরাময় প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সৌহার্দ্যপূর্ণ সামাজিক পরিবেশে কারও ক্যানসার হলেও তিনি হাসিমুখে বলতে পারবেন, ও, ক্যানসার? কিছু না। আমার পাশে সবাই আছে!