সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
“আমি যখন কেনসিংটন হাই স্ট্রীট দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি, তখন লাল ট্রাফিক লাইট জ্বলে উঠলো। তখন আমি ভাবলাম, হলুদ মানে হচ্ছে, ‘সাবধান’। আর লাল মানে, ‘থামো’, তোমাকে মাঠ ছাড়তে হবে।”
ইংলিশ রেফারি কেনেথ জর্জ অ্যাস্টন প্রথম কিভাবে ফুটবল খেলায় লাল কার্ড, হলুদ কার্ডের ব্যবহারের আইডিয়া পেয়েছিলেন, তা বর্ণনা করেছেন এভাবেই।
১৯৬০ এর দশকের শুরুতে ফুটবল মাঠে খেলোয়াড়রা এতটাই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিল যে, ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না।
মাঠের খেলা অনেক সময়েই দু্ই পক্ষের হাতাহাতি-মারামারিতে গড়াচ্ছিল। আহত খেলোয়াড়দের হাসপাতালে পর্যন্ত নিতে হচ্ছিল।
ফুটবল মাঠের এই সহিংসতার একটা চরম দৃশ্য দেখা গেল ১৯৬২ সালের চিলি বিশ্বকাপে।
‘দ্য ব্যাটল অব সান্টিয়াগো’
সেবার চিলির সান্টিয়াগোতে উদ্বোধনী ম্যাচ ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইয়োগোশ্লাভিয়ার মধ্যে। মাঠে দুই দলের খেলোয়াড়দের মারামারি, ঘুষোঘুষিতে কয়েকজনের হাড় ভাঙ্গলো।
একই ধরণের ঘটনা ঘটলো জার্মানি বনাম ইটালির খেলায়।
চেকোশ্লোভাকিয়া বনাম স্পেনের খেলায় গোলরক্ষক তো কয়েক মিনিটের জন্য অজ্ঞান হয়ে গেল। তার মাথায় বুট দিয়ে লাথি মারা হয়েছিল।
আর্জেন্টিনা বনাম বুলগেরিয়ার খেলাতেও কয়েকজন গুরুতর আহত হলো।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। আরও মারাত্মক ঘটনা ঘটলো এরপর চিলি আর ইটালির খেলায়।
ইতিহাসে এই ম্যাচটি ‘দ্য ব্যাটল অব সান্টিয়াগো’ নামে পরিচিত। এটি ছিল খেলার মাঠে অসংযত মারামারির একটা চুড়ান্ত উদাহারণ।
লাথি, ঘুষি তো বটেই, কি ছিল না সেই মারামারিতে। শেষ পর্যন্ত মাঠে পুলিশ ডাকতে হয়।
খেলায় চিলি জিতেছিল ২-০ গোলে। কিন্তু ঐ ম্যাচে রেফারির ভূমিকার ব্যাপক সমালোচনা হয়।
কে ছিলেন সেই ম্যাচের রেফারি? সেই একই কেনেথ অ্যাস্টন। ঐ ম্যাচের বর্বরতা, সহিংসতা তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল কি করা যায়। সেই ভাবনা থেকেই তিনি ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপের আগে এই সমস্যার সমাধান হাজির করলেন।
“আমি কোন ফুটবল ম্যাচের রেফারিগিরি করছিলাম না, আমি যেন একটি সামরিক অভিযানে আম্পায়ার হিসেবে কাজ করছিলাম”, তিনি পরে ঐ ম্যাচ সম্পর্কে বলেছিলেন।
কেনেথ অ্যাস্টন ১৯৬৩ সালে রেফারির কাজ থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি ফিফার রেফারিদের কমিটির সদস্য হন। ১৯৭০ হতে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি এই কমিটির সভাপতি ছিলেন।
১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা এবং ইংল্যান্ডের খেলায় এক নতুন কেলেংকারি ঘটলো। সেটা মোকাবেলার দায়িত্ব পড়েছিল কেনেথ অ্যাস্টনের ওপর।
ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ঐ ম্যাচে রেফারি ছিলেন জার্মান রুডলফ ক্রেইটলেইন। খেলার ৩৬ মিনিটের মাথায় তিনি আর্জেন্টিনার অধিনায়ক আন্তনিও রাত্তিনকে মাঠ থেকে বের করে দেন। রেফারি ইংল্যান্ডের পক্ষে একটি ফাউল দিয়েছিলেন, কিন্তু রাত্তিন তার প্রতিবাদ জানান। তখন তাকে মাঠ থেকে বের করে দেয়া হয়।
রেফারি ক্রেটলেইন পরে বলেছিলেন, রাত্তিনের চোখেমুখের ভাষাই বলে দিচ্ছিল তিনি কী বলছিলেন এবং তার মানে কী।
সমস্যাটা ছিল, রেফারি ক্রেইটলেইন স্প্যানিশ ভাষা জানতেন না। অন্যদিকে দুই দলের খেলোয়াড়র জার্মান ভাষা জানতেন না।
রাত্তিনকে যখন মাঠ ছাড়তে নির্দেশ দেয়া হয়, তখন তিনি তা করতে অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেছিলেন, রেফারি কী বলছিল, তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না।
খেলা দশ মিনিট বন্ধ রাখতে হয় একজন অনুবাদক না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের মাঠে এসে অনুবাদক বুঝিয়ে বললেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক রাত্তিনকে রেফারির সিদ্ধান্ত। কিন্তু তারপর তার ক্রোধ যেন আরও বেড়ে গেল।
“২২ অভিনেতাকে নিয়ে দুই অংকের নাটক”
আজকের দিনে অবশ্য কাউকে অপমান করার জন্য তার ভাষা জানার কোন দরকার নেই। আর রেফারি যেভাবে এখন খেলোয়াড়দের মাঠ ছাড়ার নির্দেশ দেন সেটা বোঝার জন্যও কোন ভাষা জানার দরকার নেই।
কিন্তু কেউ যখন ক্রোধে অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন, তখন নিয়মকানুনগুলি যেন খুবই সোজা-সাপ্টা এবং স্পষ্ট হয়, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই আজকের দিনে রেফারিরা আর মুখের কথায় নির্দেশ জারি করেন না।
কেনেথ অ্যাস্টন তখন ফিফার তরফ থেকে রেফারিং এর দায়িত্বের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তিনি বুঝিয়ে-শুনিয়ে আর্জেন্টিনার অধিনায়ককে শান্ত করলেন। ম্যাচটি যাতে পন্ড না হয়, তার ব্যবস্থা করলেন।
কেনেথ অ্যাস্টন তখন উপলব্ধি করেছিলেন, খেলার মাঠে আক্রমণাত্মক আচরণ বন্ধ করার জন্য এবং যারা এরকম আচরণ করে, তাদের শাস্তি দেয়ার জন্য একটা কিছু করতেই হবে।
আর লন্ডনের কেনসিংটনের একটা ট্রাফিক লাইটের লাল বাতি তাকে কী করতে হবে সেই ধারণাটা দিল।
২০০১ সালের ২৩শে অক্টোবর কেনেথ অ্যাস্টন ৮৬ বছর বয়সে মারা যান। ফুটবলের প্রতি তার ভালোবাসা তিনি আমৃত্যু লালন করেছেন।
তিনি একবার বলেছিলেন, “ফুটবল হওয়া উচিৎ একটি দুই অংকের নাটক, যেখানে মঞ্চে ২২ জন অভিনেতার সঙ্গে পরিচালকের ভূমিকায় থাকবেন রেফারি।”
তিনি আরও বলেছিলেন, “তবে এই নাটকের কোন পান্ডুলিপি নেই, নেই কোন কাহিনী। এর শেষ কি হবে আপনার জানা নেই, কিন্তু এই পুরো নাটকের উদ্দেশ্য একটাই, বিনোদন দেয়া।”