ওয়ালিউর রহমান বাবু :
রাজশাহী জেলা সদর থেকে নওগাঁ যাওয়ার পথে দোলাবাড়ি হাট। এখান থেকে পশ্চিমে মান্দা থানার পাকুরিয়া গ্রাম। ১৯৭১ সালে এই গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংসতার সাক্ষী এই গ্রামে আজও শোনা যায় স্বজন হারানো শোক। নিরবে কাঁদে পাকুরিয়া। প্রতিদিনের মতো গ্রামবাসীরা সেদিন তাদের কাজে বের হবার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার অভিযোগে গ্রামটি ঘিরে সকলকে মিটিং হবে বলে পাকুরিয়া ইউনাইটেড হাই স্কুল মাঠে যেতে বলে। স্কুল টির মাঠে অবস্থান নেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা।
তারা গ্রামে ঢুকে সকলকে মারতে মারতে বলতে থাকে মুক্তি কাহা? তারা নারীদেরও মারধর করে। গ্রামবাসীদের স্কুল মাঠে বসিয়ে উত্তর দিক থেকে মেশিনগান তাক করে। অনেকে প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে তাদের কাছে আকুতি করতে থাকেন। অনেকে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। কেউ কেউ হয়ে যান নির্বাক, পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের লাত্থি মারতে থাকে। গ্রাম প্রধান শমসের আলী প্রামানিক ও গ্রামের প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব পিয়ার মন্ডল নামাজের জন্য আকুতি করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের গুলি করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের বুট জুতোর আঘাতে অনেকে আহত হয়ে পড়ে যান। পাকিস্তানি সৈন্যরা মদের নেশায় বুদ হয়ে মেতে উঠে। তাদের ছোড়া মেশিনগানের গুলি থেকে শিশু, বয়স্করা রক্ষা পেলেন না। রক্তে লাল হয়ে গেল স্কুলটির সবুজ ঘাস। সহজ সরল শহিদ হওয়া মানুষদের পাশে পড়ে রইল,কাস্তে,জুয়ান,কোদাল, লাঙ্গল।
পাকিস্তানি সৈন্যরা বুট জুতো পড়ে মৃতদেহ গুলির ওপর হেঁটে দেখতে থাকে কেউ বেঁচে আছে কিনা। বেয়েনট চার্জ করে দেহগুলি খুঁচিয়ে দেয়। চারিদিকে রক্ত আর মৃতদেহ, হত্যা করা হয় ১২০ জনকে, ধরা পড়ে ১২৮ জন। যারা বেঁচে গেলেন তারা পানির জন্য ছটফট করতে করতে মারা গেলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামে আগুন দিয়ে নির্যাতন চালাতে থাকে, নারীরাও রক্ষা পেলেন না। পিপাসায় কাতর কোনরকমে বেঁচে থাকা মানুষদের পানি দিতে ছুটে আসেন এক বৃদ্ধ ও অন্যান্যরা। পাকিস্তানি সৈন্যরা ৭ জনকে নদীর ধারে ধরে নিয়ে গেলে ৪ জন পালিয়ে এলে তিনজনকে হত্যা করা হয়। এসএসসি পরীক্ষার্থী মমতাজ উদ্দিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান স্মৃতিচারনে বলেন বাড়ির পূর্ব দিক থেকে আসা গুলি শব্দ শুনেন।
এর পর পাকিস্তানি সৈন্যরা বাড়িতে ঢুকে তাকে মারতে মারতে বলে ‘মুক্তি কাহা’ ? মিটিং হোগা স্কুলমে যাও। তিনি স্কুলের দিকে যাবার সময় এক পাকিস্তানি সৈন্য বুকে অস্ত্র ধরে বলে মুক্তি কাহা আরো অনেক কিছু তিনি কিছুই বুঝলেন না। স্কুল মাঠে গিয়ে দেখলেন বাবার ঝুরু মন্ডল, পবন মণ্ডল কে। তার বাবা তাকে দেখিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের বললেন সে মুক্তি না, এশুনে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের গুলি করে। মমতাজ উদ্দিন কে গুলি করলে গুলিটি আরেকজনের মাথায় বৃদ্ধ হয়। অনেকে নামাজ পড়তে চাইলে তাদের নামাজ পড়তে না দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি করতে থাকে। মমতাজ উদ্দিন দেখলেন চারপাশে মৃতদেহ আর রক্ত। তাকে নেয়া হয় গ্রাম্য ডাক্তার আব্দুল গফুরের কাছে।
জমির উদ্দিন মন্ডল এর বাড়িতে সেলটার নেয়া ছাত্রলীগ কর্মী আশরাফুল ইসলাম নদী সাঁতরে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে দরজা খুলতেই পাকিস্তান সৈন্যের আঘাতে পড়ে গেলে, একজন চুল ধরে টেনে তুললে আরেকজন পিঠে ঘুষি মেরে ফেলে দিয়ে স্কুল মাঠে যেতে বলে। তিনি দেখলেন পাকিস্তানি সৈন্যরা আসছে, মাথার উপর হাত তুলে এগোতে থাকেন। একজন ধমক দিয়ে তাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলে।
জ্বলন্ত আগুনে পুড়তে থাকা ঘরের চাল সরিয়ে ফেলতে ফুফু আফজান বেগমকে সহযোগিতা করার সময় দেখলেন পাকিস্তানি সৈন্য। একজন কাছে আসতে বলে তাকে টেনে হেচড়ে স্কুল মাঠে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। পাশে থাকা নজরুলের ইশারায় দেখেন নজরুলের বাবা বিনোদ মন্ডল, ভাই মকবুল, বয়েজ, জেকের, নহীরসহ অনেকের মৃতদেহ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছে।
বিশাল দেহের সাবির উদ্দিন সরদার কে মাটিতে বসিয়ে বেঞ্চে বসে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা মদ সিগারেট নিয়ে আনন্দে মেতেউঠে। মদের বোতল হাতে ধরে থাকা এক মেজর কৃষক কদম আলী কে বলে,’মুক্তি কোন হায়’? উনি ‘উত্তর দেন,’হামাক মারা ফেললেও মুক্তির কথা বলবার পারমু না’। একজন তার কথা উল্টো করে বলে’ হাম জান কোরবান কার দেঙ্গা লেকিন মুক্তিকা নাম নেহি বাতায়েগা’ কদম আলী কে বেয়েনট চার্জ করা হলেও তিনি এক পাকিস্তানি সৈন্য কে ধরার চেষ্টা করলে আবার তাকে বেয়েনট চার্জ করা হয়।
মেজরটি অস্ত্র তাক করলে এক সৈন্য তাকে কি যেন বললে বয়স্ক শিশুদের আলাদা করে তিনি তাদের বলে ‘ঘার যাইয়ে’।কালেমা,গুলি,আত্মচিৎকা
জ্ঞান ফিরে আশরাফুল ইসলাম শুনলেন মিলিটারি মিলিটারি চিৎকার। একটি বাড়ির বাঁশের মাচার নিচে আশ্রয় নিলে তার শরীরে নামতে থাকে জোঁক, শুনতে পেলেন আত্মচিৎকার। নাহির নাপিতের বাড়িতে আশ্রয় নিলে খবর পেয়ে তার ভাইয়েরা তাকে বাড়ি নিয়ে যায়।
গ্রামবাসীরা ৮২ জন শহিদ কে স্কুলটির পাশে সমাহিত করেন। এ ঘটনার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থান কে শক্তিশালী করেন। আহত মমতাজ উদ্দিন পরে এই স্কুলটির সাথে সম্পৃক্ত হন। প্রতিদিন তিনি স্কুলে এসে চেয়ে থাকতেন শহিদদের সমাহিত স্থানের দিকে। আশরাফুল ইসলাম শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষকতায় সম্পৃক্ত হন। লিখেন’রক্ত স্নাত ২৮ আগস্ট ৭১ এর ভয়াল স্মৃতি’। স্কুল কর্তৃপক্ষ দিনটিতে কর্মসূচি গ্রহণ করে প্রজন্মদের কাছে এই দিনের ঘটনা তুলে ধরে থাকেন।
বেঁচে যাওয়া, আহত গ্রামবাসীরা ক্রমে হারিয়ে ফেলেন শক্তি, অনেকে হয়ে যান উন্মাদ। অনেকে করতে থাকেন ভিক্ষা। নারীরা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ, কেউবা অন্ধকার পথে জড়িয়ে যায়। অনেকের অভিযোগ অনেকে সেখানে গিয়ে নানা কথা বলে স্বপ্ন দেখান কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় না।
সাহায্য গেলে সেগুলি চলে যায় অন্যদের কাছে। আতুরযান,আসিয়া, জহুরুল, ওকিনা, ইসাক, ভাদনী, চৈতি, মেহেরজান এরকম অনেক অনেক দুঃখের কথা শোনান। তাদের সাথে আর দেখা হয়নি।
(লেখক-সমাজ ও সাংস্কৃতিক কর্মী)
০১৯১১৮৯৪২৬০