পশ্চিমা চাপের ‘প্রতিষেধক’ হবে ল্যাভরভের সফর?

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর অব্যাহত চাপের মধ্যে ঢাকায় ঝটিকা সফর করে গেলেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। তিনি বার্তা দিয়ে গেছেন ঢাকার সঙ্গে রাজনৈতিকসহ সব ধরনের সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী মস্কো। একই সঙ্গে তিনি ইন্দো প্যাসিফিক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতির প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন।

ল্যাভরভের এ সফর ঢাকা-মস্কোর সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন ঢাকার কূটনৈতিক অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমাদের যে অব্যাহত চাপ, ল্যাভরভের সফরের পর তা থেকে কিছুটা হলেও ‘মুক্তি’ পেতে পারে বর্তমান সরকার। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফরকে অনেকটা ‘প্রতিষেধক’ হিসেবে দেখছেন তারা। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান ও মনোভাবেও পরিবর্তন আনতে পারে ল্যাভরভের এই সফর। এ ছাড়া ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে বাংলাদেশের ভূমিকা কী হবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও এ সফর প্রভাবিত করবে।

ঢাকার দায়িত্বশীল এক কূটনীতিক বলেন, রাশিয়া সেই অর্থে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করায় পাল্টা জবাব হিসেবে রাশিয়াকে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে রাশিয়ার আগ্রহ খুব বেশি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যেদিকে, রাশিয়া তার উল্টোদিকে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ এ বিষয়ে বলেন, প্রথমবার রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করলেন। এটি অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। আঞ্চলিক সমীকরণ বিবেচনায় বন্ধুরাষ্ট্র খুঁজতে রাশিয়া উদ্যোগী হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ, বে অব বেঙ্গলে সেন্ট্রালি ডমিনেট করে, ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আমেরিকার যে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, তা দেখেও রাশিয়া এ অঞ্চল ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে— এটি মনে করার কোনো কারণ নেই।

বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি আগ্রহ রাশিয়াসহ অনেক দেশ মেনে নিতে পারছে না বলে উল্লেখ করেন আবদুর রশীদ।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, বিশেষ করে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অতি আগ্রহের কারণে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যারা এ অঞ্চলের সমীকরণের অংশীদার তারা এখন একে একে তাদের মন্তব্য পেশ করছেন। এসব মন্তব্য এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়টি বাংলাদেশের কূটনীতিতেও নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশকে এ অঞ্চলে পশ্চিমাদের চাপ থেকে কিছুটা হালকা করার জন্য রাশিয়ার সমর্থন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের এবারের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন অনেক আগে থেকে সরব। ওয়াশিংটন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়ে অব্যাহতভাবে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। একই ইস্যুতে রাশিয়া একেবারেই বসে আছে এমনও নয়। ঢাকায় রুশ দূতাবাস ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়ে সময়ে সময়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং মস্কোর সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপের পরও জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করায় ঢাকা সফরে ল্যাভরভ বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রতি মস্কোর সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশীদার বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিকসহ সর্বস্তরে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী রাশিয়া।

এদিন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ইন্দো প্যাসিফিক কৌশলের নামে তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) লক্ষ্য চীনকে প্রতিহত করা এবং রাশিয়াকে একঘরে করে ফেলা। যা কার্যত বৈশ্বিক পরিসরে ন্যাটো সম্প্রসারণেরই অংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না– জানতে চাইলে আবদুর রশীদ বলেন, দেশ থাকলে, দেশের গুরুত্ব থাকলে বিদেশিদের আগ্রহ থাকবে এবং সেখানে দ্বান্দ্বিক পরিবেশও তৈরি হবে। এ দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়েই আমাদের চলতে হবে। বাংলাদেশ শূন্য ঝুঁকিতে আছে— এটা বলার কোনো সুযোগ নেই। ঝুঁকি থাকবেই। বৈশ্বিক যে স্নায়ু যুদ্ধ, তার মধ্যে যে মেরুকরণ, তাতে আমরা অস্থিরতা দেখতে পাচ্ছি। সেই মেরুকরণে বাংলাদেশ কারও সঙ্গে এখনো যুক্ত হয়নি। বাংলাদেশ ভারসাম্য পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখেছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যারা হস্তক্ষেপ করতে চায়, সেটা মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশেরও কিছুটা বৈদেশিক সমর্থন প্রয়োজন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে বিশ্ব এখন বিভাজিত।

ল্যাভরভের সফরের মূল্যায়ন নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ ওয়ালিউর রহমান বলেন, ল্যাভরভের ঢাকা সফর আমাদের জন্য একটা ‘বিগ ডে’ ছিল। ঐতিহাসিক বন্ধুকে আমরা সম্মানের সঙ্গে বরণ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ল্যাভরভ বৈঠক করেছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইউক্রেন সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা বলেছেন। ল্যাভরভ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, রূপপুর প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ করবেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা সহযোগিতা করার কথা বলেছেন। মস্কো আমাদের রাজনৈতিক আশ্বাস দিয়ে গেছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল আমাদের, বর্তমান রাশিয়ার সঙ্গে সেই সম্পর্কের প্রতিফলন দেখা গেছে ল্যাভরভের সফরে।

উল্লেখ্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের আমন্ত্রণে গত ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সফরে আসেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। তিনি ওইদিন রাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। পরদিন ৮ সেপ্টেম্বর সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এরপর ভারতে চলমান জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের লক্ষ্যে ঢাকা ছাড়েন ল্যাভরভ।