নিজস্ব প্রতিবেদক:
হাসিনা সরকারের পতনের দিন গত ৫ আগস্ট থেকেই রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) সাবেক মেয়রসহ অন্তত ২৬ জন কাউন্সিলর আত্মগোপন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে এসেছেন এলাকায়। তবে এখনো অন্তত ২০ জন কাউন্সিলর আত্মগোপনে রয়েছেন। সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনসহ এসব কাউন্সিলরের নামে হত্যা এবং বিএনপির অফিস ভাঙচুরের অভিযোগে পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতে তারা এখন পলাতক রয়েছেন। ৫ আগস্টই ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে অনেক কাউন্সিলরের অফিসে।
এখনো আতঙ্কে অফিস করতে পারছেন না কোনো কোনো কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিবও। বাধ্য হয়ে তাঁরা সিটি করপোরেশনে অফিস করছেন। কিন্তু কাউন্সিলর না থাকায় এলাকার সাধারণ মানুষ অন্তত ১৪টি সেবা নিতে গিয়ে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
এমনকি অনেকেই জরুরী প্রয়োজনে জন্ম নিবন্ধন ও ওয়ারিশন সনদ নিতে গিয়েও খালি হাতে ঘুরে আসছেন। বাধ্য হয়ে কোনো কোনো কাউন্সিলর পলাতক থেকেই স্বাক্ষর করছেন সনদে।
সূত্র মতে, গত বছরের ২১ জুন রাসিক নির্বাচনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে তৃতীয় বারের মতো বিজয়ী হোন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তাঁর পাশাপাশি নির্বাচনে সিটি কর্পোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডের ২৬টিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। গত ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরই তৎকালীন মেয়র লিটনসহ আত্মগোপনে যান ২৬ কাউন্সিলর। যাঁদের মধ্যে ৬ জন আবার এলাকায় ফিরে এসেছেন। কিন্তু এখনো পলাতক রয়েছেন আরও অন্তত ২০ জন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। হত্যা অথবা মহানগর বিএনপির অফিস ভাংচুরের অভিযোগে মামলায় আসামি করা হয়েছে তাঁদের।
এসব কাউন্সিলরদের মধ্যে রয়েছেন, নগরীর ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজব আলী, ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামাল হোসেন, ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মতিউর রহমান, ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জানে আলম, ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাশেল জামান, ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ আব্দুল মমিন, ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন আনার, ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহাদত আলী শাহু, ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম, ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌহিদুল হক সুমন, ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিযাম উল আযিম, ২২ নম্বর নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল হামিদ টেকন, ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহাতাব উদ্দিন, ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরমান আলীসহ ২০ জন।
এলাকায় ফিরে এসেছেন ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামরুজ্জামান কামরুসহ অন্তত ৬ জন। কামরু একসময় ওয়াকার্স পার্টি করতেন। সেখান থেকে সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর হাত ধরে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। পরে আবার সাবেক মেয়র লিটনের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছিলেন। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বেলাল উদ্দিনও, ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম পচাসহ অনেকেই। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন আবার বিএনপিতে ফিরে গেছেন। তবে এখনো অন্তত ২০ জন পলাতক থাকায় ওই ওয়ার্ড এলাকার মানুষ কাউন্সিলর কার্যালয়ের অন্তত ১৪ ধরনের নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
নগরীল ডিঙ্গাডোবা এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানা বলেন, ‘আমার বাড়ি তিন ওয়ার্ডা এলাকায়। আমার স্ত্রী মারা গেছে বেশকিছুদিন হলো। তিনি সরকারি চাকরি করতেন। তাঁর প্রোভিডেন্ট ফান্ডের টাকাগুলো উঠাতে ওয়ারিশন সনদের দরকার। জরুরী এই সনদটি ছাড়া কোনো কাজই আমরা করতে পারছি না। কিন্তু কাউন্সিলর পলাতক থাকায় আমি সেই সনদ নিতে পারছি না।’
নগরীর তেরোখাদিয়া এলাকার বাসিন্দা নাসিমা খাতুন বলেন, আমার ছেলে বিদেশ যাবে। আমার ছেলে এই এলাকার বাসিন্দা কিনা সেটির একটি প্রত্যায়ন দরকার। পাশাপাশি নাগরিক সনদও দরকার। কিন্তু কাউন্সিলর না থাকায় আমি সেটি পাচ্ছি না।’
নগরীর শিরোইল এলাকার বাসিন্দা নাজমুল হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলের জন্মনিবন্ধন করবো। কিন্তু কাউন্সিলর এলাকায় নাই। কাউন্সিলরের কার্যালয়ে গিয়ে জানতে পারি কার্যালয়টিও ভেঙে লুটপাট চালানো হয়েছে। কম্পিউটার নিয়ে যাওয়া সচিব কোনো কাজ করতে পারছেন না বলে জানালেন। কিন্তু আমার জরুরী দরকার জন্মনিবন্ধন সনদটি।’
একইভাবে প্রতিদিন কাউন্সিলর কার্যালয়ে নানা কাজে গিয়েও খালি হাতে ফিরে আসতে হচ্ছে নগরীর হাজার হাজার মানুষকে। জানতে চাইলে দুইজন কাউন্সিলর পলাতক থাকা অবস্থায় হোয়াটসঅ্যাপে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সদন প্রদানসহ এলাকার ছোট-খাটো জটিলতা নিরসনের সালিশ করি। সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সচিবদেরও কার্যালয়ে যেতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ভয়ে তারা সিটি করপোরেশনে অফিস করছেন। আমরাও মামলার ভয়ে আত্মগোপনে আছি। ফলে নাগরিকরা নানা ধরনের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’
জানতে চাইলে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘অনেক কাউন্সিলরই এলাকায় থাকতে পারছেন না বলে শুনেছি। নগর ভবনসহ কোনো কোনো ওয়ার্ড কার্যালয়ও হামলা, ভাচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ফলে নাগরিক সেবা থেকে অনেকেই নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে নাগরিকরা চাইলে পাশের ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের নিকট থেকে অথবা নারী কাউন্সিলরদের নিকট থেকে সেসব সেবা নিতে পারবেন। এনিয়ে জটিলতা তৈরী হবে না।’