নিজস্ব প্রতিবেদক:
জুলেখা বিবি। স্বামী-সন্তান নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবার তাঁর। জন্ম নেওয়ার পর থেকেই চরেই বসবাস তাঁর। চরের এ নারীর বয়স এখন প্রায় ৬০ বছর। এরই মধ্যে জুলেখা খাতুন অন্তত ১২-১৩ বার নিজের বাড়িটি ভাঙতে দেখেছেন চোখের সামনে।
শেষবার গত বছরের বন্যায় তাঁর শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে যায় প্রমত্তা পদ্মায়। এই অবস্থায় সর্বনাশা পদ্মার বুকে আছড়ে পড়া ছাড়া যেন কোনো উপায়ই ছিল না জুলেখার। কিন্তু সেই পদ্মায় তাকে ফিরে দিয়েছে আবার বাড়ি।
পদ্মার মাঝখানে জেগে উঠা চরে (দ্বীপের মতো দেখতে) চলতি বছরের মার্চ মাসের দিকে নতুন করে পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয় গড়েছেন জুলেখা। এরপর থেকেই এখানেই বসবাস করছেন ওই নারী এবং তার পরিবার।
শুধু জুলেখায় নন, তাঁর মতো আরো প্রায় তিন ‘শ’টি পরিবারের ঠাঁই হয়েছে রাজশাহী নগরীর অদূরে পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের মাঝ চর এলাকায়। চর খিদিরপুর ও চর খানপুর এলাকার মাঝামাঝি একেবারে পদ্মার মাঝকানেই গড়ে উঠেছে এ চর। চরের দুই দিক দিয়ে চলে গেছে পদ্মা।
উত্তর ও দক্ষিণ দিক দিকে যাওয়া ভয়াল পদ্মা আবার নতুন করে ভাঙতে শুরু করেছে জেগে উঠা মাঝ চরটিও। ফলে বার বার সহায়-সম্বল হারানো অন্তত তিন শটি পরিবার নতুন করে নীড় ফিরে পেলেও তাঁরা আবারো ভাঙনের শঙ্কায় দিন-রাত পার করছেন। বর্ষায় তীব্র ভাঙনে এই চরের জেগে উঠা প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমিও পড়েছে হুমকির মুখে।
জুলেখা বলেন, আমাদের প্রায় ৩০ বিা জমি ছিল। চর খিদিরপুরে কিন্তু ভাঙতে ভাঙতে সব শ্যাষ। বাড়িও ভাঙতে হয়েছে অন্তত ১২ বার। গত বছর বাড়ির শেষ ভিটাটুকুও গ্যাছে পদ্মার পানিতে। এরপর বাড়ির সবাই মিলে এই চরে অ্যাসে বাড়ি করেছি। কিন্তু আবার এই (মাঝ চর) চরও ভ্যাঙছে। এটা ভাঙি গেলে যাব কোথায়?
প্রায় একই কথা বলেন পদ্মার মাঝ চরের সর্ব প্রথম বাসিন্দা জালাল উদ্দিন। তিনি জানান, এই চরটি বছর ছয়েক আগ থেকে জেগে উঠতে শুরু করে। এরপর তিনি প্রায় চার বছর আগে চর খানপুর থেকে সব হারিয়ে এখানে এসে বাসা গড়েন। চর খানপুর ছেড়ে আসার আগে ওই চরে তাঁর অন্তত দেড় শ বিঘা জমি ছিল। কিন্তু বছর বছরে ভেঙে পদ্মা সব গ্রাস করেছে। এখন সেখানে বর্ষাকালে অথৈ পানি। আবার সুষ্ক মৌসুমেও পানি থাকে। আবাদও করা যায় না। উপায়ন্তর না দেখে জালাল চার বছর আগে মাঝ চরে এসে বাসা বাধেন। এখানে তিনি এখন ৪০টি গরু পালন করে সংসার চালান।
জালাল জানান, তাঁর দেখা-দেখি গত বছর থেকেই একে একে চর খানপুর ও চর খিদিরপুর এলাকা থেকে ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো এসে মাঝ চরে এসে বাসা বাধতে শুরু করে। ওপরে টিনের চালা আর নিচে বেড়া দিয়ে গড়ে তোলা ছোট ছোট ঘরগুলোও দেখতে একেকটি কুঠিরের মতো। এসব ঘরেই বসবাসকারী মানুষগুলোর দিন কাটছে আবারো নতুন করে ভাঙনের আতঙ্কে।
স্থানীয় হরিয়ান ইউপি চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বলেন, পদ্মার মাঝখানে জেগে এই চরটি আমাদের জন্য আর্শিবাদ স্বরুপ। নদীর দক্ষিণ পাার ভাঙছে। কিন্তু এই জেগে উঠা চরে ওপারের মানুষগুলো এসে নতুন করে আশ্রয় গড়ার জায়গা খুঁজে পেয়েছে। তাদের এই জায়গাটি আবার ভাঙতে শুরু করেছে। তবে দুই ধর দিয়ে স্থায়ীভাবে বাধ নির্মাণ করা হলে এই ভাঙন ঠেকানো যাবে। পাশাপাশি এই চরকে একটি সম্ভাবনাময় চর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। এমনকি বিশালকার একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে তোলা যাবে এই চরটিকে যেটে বর্ষা মৌসুমে পুরো দ্বীপের মতো আকার পাবে।
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের এমপি আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘এটি একটি সম্ভাবনাময় চর। এই চরটিকে ধরে রাখতে পারলে আমাদের উপকারই হবে বেশি। এখানকার মানুষগুলোরও একটি স্থায়ী জায়গা হবে। তাই এদের এখানে বাস-উপযোগী করতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমি কার্যকরী ভ’মিকা রাখবো। এমনকি এখানে এরই মধ্যে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্যেও উদ্যোগ নিব, যাতে করে এই চরের শিশুরা ঝরে না পড়ে।’
স/আর