সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :
আমার এক পাড়াতুতো ভাতিজার বয়স তিরিশ ছুঁই ছুঁই। ছোটবেলা থেকেই গুডবয় হিসেবে পাড়ায় তার সুনাম আছে। সেই প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব ক্লাসেই ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়ে পাশ করে বছর কয়েক আগে মাশাল্লাহ একটা হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রসম্মত চাকরিও পেয়েছে নামকরা এক কম্পানিতে। কিছুদিন আগে বিয়ে করে ঘরে এনেছে লক্ষ্মীমন্ত বৌ।
সেদিন রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা হতে কুশল বিনিময়ের পর ভাতিজা বেমক্কা জানতে চাইল, ‘চাচা, এবার কি ভোট হইব? ভোট দিবার পারুম? আমার ভোট দেওয়ার বয়স হওনের পর তিন-চারটা ভোট হইল, কিন্তু একবারও তো ভোট দিতে পারি নাই। পয়লাবার মহল্লার মাস্তানরা কইল ভোট দিতে যাওন লাগব না, হেরাই ভোটের বেবস্তা করব। এরপরের বার ভোট দিতে গিয়া দেহি আমার ভোট কেডা জানি দিয়া গেছে। তারপরের বার…।’
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘এইবার ইনশাল্লাহ ওই রকম কিছু অইব না। তুমি আর বৌমা তোমার আব্বা-আম্মারে সঙ্গে কইরা গিয়া নিশ্চিন্ত মনে ভোট দিয়া আসবা।’…
সেদিন ভাতিজাকে তো খুব আশার বাণী শুনালাম কিন্তু বাসায় ফিরে আমার ময়ূরসিংহাসন ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিতেই নানা রকম দুশ্চিন্তা মাথায় কিলবিল করে উঠল। বাপের তালুকদারি ছেড়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে এক অঘটনঘটনপটীয়সী মহীয়সী নারী রিমোট কন্ট্রোলে নাকি নানা রকম ঘোঁট পাকানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
আর তাঁর মুরুব্বি তাঁকে শুধু ‘তু ক্যাম্চু’ (গুজরাতি ভাষায় ‘তুমি কেমন আছ?’) বলে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা তাঁর খোঁজ-খবরই নিচ্ছেন না, ‘র’-ল-ব-শ ইত্যাদি যত সেবাইত আছে সবাইকে নাকি তাঁর ফুট-ফরমাশ খাটতে লাগিয়ে দিয়েছেন। আর তারা তিলকে তাল, তালকে কাঁঠাল বানিয়ে বাংলাদেশে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে কচুকাটা হচ্ছে সেইসব কাল্পনিক কাহিনি ওই দেশের কিছু কিছু মতলবাজ গণমাধ্যমের সাহায্যে বিশ্ববাসীকে পরিবেশন করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের বন্ধুর পোষ্য পত্র-পত্রিকা ছাড়া জাতীয় বা আন্তর্জাতিক আর কোনো গণমাধ্যমে এত বড় সংখ্যালঘু-নিধনের কোনো খবরই নেই। এমন কি বাংলাদেশের যেসব নেতৃস্থানীয় পত্র-পত্রিকা তাদের নিরপেক্ষতার জন্য সুপরিচিত তারাও এত বড় ঘটনার ব্যাপারে একেবারে ‘স্পিকটি নট্’। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্তমান অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার এই হীন প্রচেষ্টা কেবলমাত্র বোনকে তার হূত সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে ভাইয়ের নানাবিধ অপকৌশলের একটি মাত্র।
আরেকটি বিষয় ভুললে চলবে না। শে. হা. সরকারের সময়ে দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে যেসব আমলা-কামলা মালাই-মাখন খেয়ে খেয়ে নিজেদের নধরকান্তির শ্রীবৃদ্ধি করেছেন, যেসব রাজনৈতিক লুটেরা জনগণের রক্ত চুষে চুষে পান করে আঙুল ফুলে কলাগাছ-বটগাছ হয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই এখনো কেরানীগঞ্জ-গাজীপুরের রাষ্ট্রীয় মেহমানখানার বাইরে রয়ে গেছেন। এদের অনেকেই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে অহর্নিশ
হূতরাজ্য ফিরে পাওয়ার নানাবিধ ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। এরা হাজার কোটি টাকা খরচ করে রাতারাতি ভোল পাল্টে বৈষম্যবিরোধী বা ইউনূসপন্থীও হয়ে যেতে পারেন। আর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে থেকে বড় রকমের ‘স্যাবোটাজ’ও করতে পারেন এরা।
জ্বী হ্যাঁ, এদেশে সবই সম্ভব। কাজেই এদের ব্যাপারে অনুরোধ-উপরোধ নয়, রীতিমত ১০ নম্বর বিপদসংকেত জানাচ্ছি : সাধু সাবধান! অপ্রিয় হলেও সত্য, ইন বাংলাদেশ অলমোস্ট এভরিথিং অ্যান্ড এভরিওয়ান হ্যাজ আ প্রাইস্। আমার চাকরিজীবনে আমি যখন বাংলাদেশ জুটমিলস্ কর্পোরেশনে (বিজেএমসি) বেশ কিছুদিন পাটজাত দ্রব্য বিপণনের দায়িত্বে ছিলাম, তখন আমার এক অনুজপ্রতিম চৌকশ সহকর্মীর কাছে মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীদের সম্বন্ধে শুনেছিলাম, তারা নাকি তাদের ব্যবসার মূলনীতি হিসেবে ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল’ নীতি মেনে চলত একেবারে ধর্মীয় অনুশাসনের মতো। কোনো লোক ঘুষ খায় না শুনলে তারা নাকি বলত : ক্যায়া? পয়সা নাহি লেতা? কেতনা তক নাহি লেতা? (কী? পয়সা নেয় না? কতটুকু পর্যন্ত নেয় না?) অর্থাৎ, ঘুষ খায় না? কত টাকা পর্যন্ত খায় না? টাকার অঙ্ক বাড়াতে থাকো, এক পর্যায়ে নিশ্চয়ই ঘুষ খাওয়ার জন্য মুখ হা করবে।
জানি, এতক্ষণ কালোয়াতি শুনে শুনে আপনারা হাই তুলছিলেন। এবার তাহলে আসি আসল কথায়। আসল কথা আর কিছু না, সূচনা পর্বে উল্লিখিত আমার সেই পাড়াতুতো ভাতিজার ভোট দেওয়ার খায়েশের কথা। হ্যাঁ, এবার নিশ্চয়ই তার আশা পূর্ণ হবে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাকে তো আমরা সেই ষাটের দশক-সত্তরের দশক থেকে দেখে আসছি। তাঁর ভেতর কোনো দুই নম্বরি-আড়াই নম্বরি কিছু আমরা, বা যাঁরা তাঁকে নোবেল প্রাইজ দিয়ে বিশ্ববরেণ্য করেছেন তাঁরা, কখনো দেখিনি। রক্তরঞ্জিত জুলাই ৩৬-এর উৎসর্গীকৃতপ্রাণ দেশপ্রেমিক শিক্ষার্থীরা ১৭ কোটির মধ্য থেকে যোগ্যতম ব্যক্তিটিকেই বেছে নিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশে-বিদেশে এক নামে বাংলাদেশের কোনো জীবিত ব্যক্তিকে যদি লোকে চেনে তবে তিনি প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। আমি লন্ডনে বাংলাদেশের হাই কমিশনারের দায়িত্বে থাকার সময় রাজা চার্লস (ওই সময়ে প্রিন্স চার্লস) ২০০৪ সালে আমার সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই করমর্দন করতে করতে বলেন, ‘ও, ইউ আর ফ্রম বাংলাদেশ?’ তারপরের বাক্যই ‘হাউ ইজ মাই গুড ফ্রেন্ড প্রফেসর ইউনূস?’ তারপর আরো বার তিনেক আমার দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। প্রত্যেকবারই কুশল বিনিময়ের পর এসেছে প্রফেসর ইউসূস প্রসঙ্গ।
আমাদের পরম সৌভাগ্য যে এমন একজনকে দেশের এই ক্রান্তিকালে আমরা সরকার প্রধান হিসেবে পেয়েছি। তিনি গত তিন মাসে বারবার এটা স্পষ্ট করেছেন বাংলাদেশ নামক লাইনচ্যুত রেলগাড়িটিকে যথাসম্ভব দ্রুত লাইনে তুলে দিয়ে তিনি তাঁর দলবল নিয়ে খোদা হাফেয জানাবেন। দেশবাসীও তাই মনে করে। তবে হ্যাঁ, গাড়িটি যাতে আবার বেলাইন না হয় সে ব্যবস্থা তিনি করে যাবেন বলেছেন। ভালো কথা। কিন্তু আমাদের তো আবার কোনো ব্যাপারেই তর সয় না। তা ছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার জন্য যারা আদাজল খেয়ে তলে তলে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা তো নানা প্রকার অকথা-কুকথা বলে বলে পাবলিককে খেপিয়ে তোলার ধান্ধায় থাকবে। তাই আমরা মনে করি, একেবারে আশু প্রয়োজনীয় বিষয়াদি—যা একটি সুষ্ঠু সুন্দর ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য—ব্যতীত অন্যসব সংস্কারের কাজে কালক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। তা ছাড়া সংস্কার তো একটি চলমান প্রক্রিয়া। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার বা ভবিষ্যতের সরকাররা নিশ্চয়ই জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন এসব ব্যাপারে।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা সম্প্রতি (১৭ নভেম্বর) জাতির উদ্দেশে তাঁর ভাষণে সরকারের ১০০ দিনের শাসনামলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে তা স্পষ্ট করে বলেননি। তবে নির্বাচনের আগে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যেসব সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো সম্বন্ধে বলেছেন। তার মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচনও এসে যায়। এতেই অনেক বিদূষক দু’য়ে দু’য়ে চার মিলিয়ে ধরে নিয়েছেন এই সরকার শিগগির যাচ্ছে না। (ওই দিন রাতেই এক টিভি চ্যানেলে আমার এক সহ-আলোচক প্রবীণ সাংবাদিক বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলেই বসলেন : ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি/তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি’। জবাবে আমি বোধ হয় ‘ধৈর্য ধরো, তিষ্ঠ ক্ষণকাল’ জাতীয় কিছু বলেছিলাম।)
এখনো বলি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একটি সুষ্ঠু সুন্দর অংশগ্রহণমূলক ও দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় ও যৌক্তিক সময় দিতে হবে। অবশ্য যৌক্তিক বলতে নিশ্চয়ই অনির্দিষ্টকাল বোঝায় না। সেই কারণে বিভিন্ন মহল থেকে একটি রোডম্যাপ বা আগামী দিনের কর্মপন্থা (আজকাল রোডম্যাপ বা পথনকশা কথাটাই বেশি চাউর) ঘোষণার যে অনুচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত দাবি উঠেছে তা আমলে নিয়ে সরকারের উচিত একটা সুস্পষ্ট ধারণা জাতিকে দেওয়া—কবে নাগাদ তারা নির্বাচন করবেন। এটা না করলে বর্তমানের ধূমায়িত অসন্তোষ তাদের জন্য অদূর ভবিষ্যতে একটা বাজে ধরনের শিরঃপীড়ার কারণ হতে পারে।
তবে সব কথার শেষ কথা, ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের ফলে বাংলাদেশ যে রাহুমুক্ত হয়েছে তার ফসল ঘরে তোলার কিন্তু একটা সুবর্ণ সুযোগ আমরা পেয়েছি, যা হেলায় হারানো হবে একটা জাতীয় বোকামি। এখন সর্বাগ্রে যা দরকার তা হলো জাতীয় ঐক্য। আর সেই ঐক্য অর্জনের জন্য ১৭ কোটির কিন্তু বিশাল কোনো চাহিদা নেই। তাদের দুই বেলা পেট পুরে দুটো খাবার ব্যবস্থা করে দিন, আর শান্তিতে ঘুমুতে দিন, দেখবেন তারা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অন্তর থেকে ভালবাসছে, দু’আ করছে।
কিন্তু, কিছু মনে করবেন না, এই দুই ‘পেপারেই’—মূল্যস্ফীতি আর আইনশৃঙ্খলা—পরীক্ষক সাধারণ মানুষ সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আপনাদের পাশ মার্ক দিতে পারছে না। সদাশয় কর্তৃপক্ষ, জরুরি ভিত্তিতে এই দুই ‘পেপারের’ জন্য কিছু একটা করুন। নইলে—।
লেখক : সাবক সচিব, কবি
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন