মো.কায়ছার আলী :
বাংলাদেশ হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দেশ।আবহমানকালের স্বাক্ষী প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রায় প্রতিটি জনপদে বিদ্যমান। প্রত্ন মানে পুরাতন ও প্রাচীন। তত্ত্ব মানে বিমূর্ত ,অনুমান, ধারণা ,অনুমিত,কল্পনা ও সিদ্ধান্ত ইত্যাদি। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হলো জিনিসপত্র,মুদ্রা,অট্টালিকা, স্থাপত্য,গয়না,ধাতব অস্ত্র ইত্যাদি।
প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্নে ইতিহাসের শেকড় প্রোথিত আছে।নরসিংদীর উয়ারী -বটেশ্বর,মুন্সীগঞ্জের নাটেশ্বর ,বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর সোমপুর বিহার,কুমিল্লার ময়নামতি,পঞ্চগড়ের ভেতরগড়ের সাথে যোগ হয়েছে উত্তরবংগের লালমনিরহাট জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রামে তিস্তা নদীর পাড়ে একটি প্রাচীন মসজিদ। মসজিদ আল্লাহর ঘর।দুনিয়ার সবচেয়ে প্রিয় স্থান। এক ইমামের নেতৃত্বে মুসলমানেরা সেখানে শ্রদ্ধাভরে,বিনয়ের সাথে স্বেচ্ছায় মাথা নত বা সিজদাহ্ করে। আল কোরানের তেলওয়াত ও হাদিসের চর্চার মাধ্যমে পরস্পরে আলোচনা করে দুনিয়া ও আখেরাতের মুক্তির কামনা করে।সেসময় আল্লাহপাকের রহমত বর্ষিত হয়। মসজিদ নির্মাণ ও খেদমতে আত্মনিয়োগ করা অনেক সম্মানজনক কাজ এবং নিয়মিত মসজিদে যাতায়াত ঈমানের পরিচায়ক। হাদীসে উল্লেখ আছে “কেয়ামতের দিন সাত শ্রেনীর লোক আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবে”। ঐ হাদীসের তৃতীয় নাম্বারে বলা আছে “যাঁদের অন্তর মসজিদের সাথে লেগে থাকে “অর্থাৎ আজান শোনা মাত্রই দুনিয়ার সকল কাজকর্ম ছেড়ে মসজিদে সালাত আদায়ের জন্য ছুটে যান।
স্থায়ীভাবে সালাত আদায়ের জন্য যে ঘর নির্মাণ করা হয়, সেটাই মসজিদ। জুমআ নামাজ কায়েমের স্থানই হলো জামে মসজিদ। গুটি কয়েক স্থান ব্যতীত মসজিদের বাইরে নামাজ কায়েমের অনুমতি আছে। তবে মসজিদে জামায়াতবদ্ধ হয়ে নামায আদায়ের সওয়াব বেশি। মানবের স্বভাব হলো নতুন কোন কিছু আবিষ্কার করা। হউক সেটা তথ্য ও প্রযুক্তি,বিজ্ঞান, বা প্রাচীন নিদর্শন। আবিস্কারের মাধ্যমে কিছু মানুষ তাঁদের নাম ইতিহাসের সোনালী পাতায় লিপিবদ্ধ করেন।সভ্যতার আদি নিদর্শন নদ-নদী। নদ- নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে প্রাচীন সভ্যতা ,শহর নগর বন্দর ও মানববসতি।তিস্তা নদীর উর্বর পলি দিয়ে গঠিত বৃহত্তর রংপুর জেলা। রংপুর ও কুড়িগ্রাম মহাসড়কে পাশে রামদাস গ্রামের পূর্বপুরুষেরা এই অঞ্চলে প্রায় ২০০ বছর আগে আগমন করেন।অতীতে এই গ্রামটির বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল ‘মজদের আড়া’। আড়া মানে জংগল বা জংগলময় স্থান। যেখানে ছিল হিংস্রপ্রাণীদের নিরাপদ বসবাস। ভয়ে কেউ দিনের বেলাতেও ভিতরে প্রবেশ করত না। নানারকম রুপকথা প্রচলিত ছিল।একদিকে তিস্তা,অন্যদিকে বিশাল জংগল। এই মজদের আড়ার পূর্ব মালিক ছিলেন পচা দালাল। ইয়াকুব আলী নামে এক ব্যক্তি সেটা কিনে নেন।উত্তরাধিকার সূত্রে সেই জমির মালিক হন নবাব আলী।
১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে স্থানীয় জনগণ কৃষি কাজ তথা চাষাবাদের জন্য জায়গাটি পরিস্কার করার উদ্যোগ নেয়।জায়গাটি পরিস্কার করে সমতল করার সময়,তারা দেখতে পায় ৭/৮টি মাটির উঁচু টিলা।তারা ভাবলেন হতে পারে সেগুলো কোন অতীত কালের রাজা বাদশাহ বা জমিদারের বাড়ি। একটি টিলা বা ঘর উত্তর দক্ষিণে ২১ ফুট লম্বা এবং পূর্ব পশ্চিমে ১০ ফুট চওড়া। ৪ টি স্তম্ভের মধ্যের ২ টি স্তম্ভ ধ্বংসপ্রাপ্ত। প্রাচীনকালের প্রচুর ইট,পোড়ামাটি এবং সেই ইটের গায়ে অংকিত কিছু নান্দনিক ফুলের চিহ্ন।সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে আইয়ুব আলী পুরনো ইটের মধ্যে একটি শিলালিপি (৬” দৈর্ঘ্য ,৬” প্রস্থ ও ২” মোটা) খুঁজে পান।পরবর্তীতে শিলালিপিটি ভাল করে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দেখতে পান সেখানে আরবিতে লিখা আছে কালেমা তাইয়েবা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্” এবং হিজরি সন ৮ই মহররম ৬৯। বর্তমানে শিলালিপিটি তাজহাট জমিদারবাড়ি রংপুর যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।মসজিদের দেওয়ালে শিলালিপিটির ছবি এবং পুরনো ইটের স্তুপ সারিবদ্ধভাবে সাজানো আছে।মূল মসজিদের প্রাচীরের দেওয়ালটির অংশ নতুন মসজিদের ভিতরে শক্ত মোটা কাঁচ দিয়ে কালের জীবন্ত স্বাক্ষী হিসাবে আমাদের এখনও অনুপ্রেরণা, শক্তি ও সাহস যোগায়।
শিলালিপিটি পেয়েই সবার টনক নড়েচড়ে উঠে। চারিদিকে হৈচৈ পড়ে গিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে যায়। শতাধিক গবেষক, প্রত্নতাত্ত্বিকবিদ ও ইতিহাসবিদের চেষ্টায় এবং আন্তর্জাতিক মানের বিশেষ করে আমেরিকার ও ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান সবকিছুই পরীক্ষা নিরীক্ষা করেই সর্বসম্মতিক্রমে নিশ্চিত হয়েই একমত পোষণ করে ঘোষণা দেন যে, এই মসজিদটি ৬৯ হিজরিতে নির্মিত হয়েছে। ১৯৯৩ সালে রংপুর টাউন হলে একটা সেমিনারের আয়োজন করা হয় যার বিষয়বস্তু ছিল”হিজরি প্রথম শতাব্দীতে ইসলাম ও বাংলাদেশ “সব আলোচক ও প্রবন্ধকার এই মসজিদকে ৬৯ হিজরি এবং সাহাবায়ে কেরামগণ কর্তৃক এই হারানো মসজিদ নির্মাণ করা মোটেই অসম্ভব নয় বলে মতামত দেন। ১৩৭২ বছর পর হারিয়ে যাওয়া মসজিদ ১৯৮৫ সালে পুনরুদ্ধার হওয়ায় মসজিদটির নাম রেখে দেন হারানো মসজিদ বা সাহাবায়ে কেরাম মসজিদ। মসজিদের সঙ্গে একটি নূরানী হাফেজিয়া ও কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। মসজিদের আবিষ্কার বিস্ময়কর বটে।
এদেশের উত্তরাঞ্চলের ইতিহাসের সাথে বিশ্বসভ্যতার সম্পর্কের আরেক ইতিহাস জানার পথ খুলে যায়। খ্রিষ্টপূর্ব থেকে রোমান, চৈনিক,আরব ও বাংলা এই চার অঞ্চলে প্রাচীন যুগে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় আরব বণিকেরা সিকিম ও চীনের ভিতর দিয়ে নৌপথের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বহরের যাতায়াত ছিল। তাদের মতে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন বাণিজ্যের নৌরুট। চীনা ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে পাওয়া যায় সাহাবিদের যুগে চারজনের নেতৃত্বে ছিলেন হজরত আবু ওয়াক্কাস (রা:)। অপর তিনজন ছিলেন হজরত কায়েস ইবনে হুজায়ফা (রা:), হজরত ওরায়াহ ইবনে আসাসা (রা:) এবং হজরত আবু কায়েস ইবনুল হারেস (রা:)।আমীর আবু ওয়াক্কাস (রা:) চীনের কোয়াংটা নদীর তীরে নির্মিত একটি মসজিদ এবং অদূরেই তাঁর সমাধি প্রায় চৌদ্দশত বছর ধরে চীনা মুসলমানদের কাছে পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য। অন্য দুইজন সাহাবী উপকূলীয় ফু-কান প্রদেশের চুয়ান-চু বন্দরের নিকটবর্তী লিং নামক পাহাড়ের পাদদেশে সমাহিত রয়েছেন। চীনের কোয়াংটা মসজিদ এবং লালমনিরহাটের হারানো মসজিদের নির্মাণশৈলী একই রকমের। তাই ধরে নেওয়া হয় যে তিনি এবং তাঁর সাথিরা হারানো মসজিদ নির্মাণ করার পর চীনে গমন করেছিলেন। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (সা:) ১০ হিজরিতে আরাফাতের ময়দানে সোয়া লক্ষ সাহাবিদের সামনে বিদায় হজ্জের ভাষণ বা খুৎবা দেন।মাত্র দশ হাজার সাহাবীদের কবর মক্কা-মদিনায় আছে।
লক্ষাধিক সাহাবী জীবন বাজি রেখে অনুপস্থিত দুনিয়াবাসীর কাছে তাঁদের মাতৃভূমি ,পরিবার পরিজন,আত্মীয় স্বজনের মায়া মহব্বত উপেক্ষা করে সবকিছুই ফেলে নিজেকে ‘দায়ী ইলাল্লাহ’ মনে করে পৃথিবী চারিদিকে আল্লাহর উপর ভরসা করে পাহাড়, পর্বত, সাগর-মহাসাগর, মূরুভূমি অতিক্রম করে আল্লাহর ওয়াস্তে বেরিয়ে পড়েন।আল্লাহপাক আল কুরআনের সূরা মুজাদালার ২২ নম্বর আয়াতে এজন্যই বলেছেন “রাদিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া রাদি আনহু” অর্থাৎ আল্লাহপাক তাঁদের উপর খুশী এবং তাঁরাও আল্লাহর উপর খুশী, সুবহানআল্লাহ। আল্লাহর মেহেরবানীতে এবং নবী (সা:) প্রিয় সাহাবীদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা মক্কা-মদিনা থেকে এতদূরে বসবাস করে শান্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলামের সুশীতল ছায়া পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। সাহাবিদের যুগের হারানো মসজিদ ফিরে পেয়েছি। আর কি কি মূল্যবান জিনিস পেলে আমরা প্রকৃত মুসলমান হতে পারব,তা আমার জানা নেই। সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক নির্মিত “হারানো মসজিদে”আপনি/আপনারা গিয়ে কমপক্ষে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে একটু হলেও মানসিক তৃপ্তি পাবেন,এ ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।
ইসলামের ইতিহাসের তথ্যমতে ১১/১২ শতকে সূফী সাধকদের মাধ্যমে এদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল।তবে ইসলামের বীজবোপন হয়েছিল সাহাবিদের সোনালী যুগে ৬৯ হিজরিতে “হারানো মসজিদ” এর প্রতিষ্ঠাকালে, এ কথায় বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।মহাকালের একমাত্র মালিক আল্লাহ রাব্বুল- আলামীন। তাই সভ্যতার পালাবদলে আর কত রহস্য লুকিয়ে আছে, এই অঞ্চলে তাও একদিন হয়তো জানা যাবে।
লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪, kaisardinajpur@yahoo.com