সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে সরকারি প্রতিষ্ঠান রেখে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান থেকে মালামাল ক্রয় করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এতে দুটি ক্যাটাগরিতে ১ কোটি ৬৪ লাখ ৬৬ হাজার ৮০৭ টাকার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। খোদ সরকারের অডিট অধিদফতর এই অনিয়মে আপত্তি জানিয়েছে। নিজের ব্যক্তি স্বার্থে সংস্থার ভাণ্ডার বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এমন কাজ করেছেন বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ২০০০ সালের ১৬ই মার্চ অনুষ্ঠিত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সভা ও একই বছরের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে পাঠানো এক পত্রে বলা হয়েছে-সব সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সব ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত দ্রব্য-সামগ্রী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্রয় করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান যদি অপারগতা প্রকাশ করে তাহলে অন্যত্র হতে ক্রয় করা যাবে। এক্ষেত্রে অপারগতা সনদ সংগ্রহ করতে হবে।
কিন্তু সংস্থাটির দু’টি ক্যাটাগরির ক্রয়ে কেন্দ্রীয় অডিট অধিদফতরের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের নিরীক্ষায় দেখা গেছে- ডিএসসিসি’র ভাণ্ডার ও ক্রয় বিভাগ সরকারি প্রিন্টিং প্রেস হতে মালামাল ক্রয় না করে বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রেস হতে মুদ্রণ করা হয়েছে। এতে করপোরেশনের এক কোটি ২৫ লাখ ৩৯ হাজার ৬২৭ টাকা অনিয়মিত ব্যয় হয়েছে।
অপরদিকে, একই অর্থবছরের অপর এক নিরীক্ষায় দেখা গেছে- ডিএসসিসির ভাণ্ডার ও ক্রয় বিভাগ সরকারি স্টেশনারি অফিস হতে মালামাল ক্রয় না করে বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হতে স্টেশনারি মালামাল ক্রয় করেছে। এতে করপোরেশনের ৩৯ লাখ ২৭ হাজার ১৮০ টাকা অনিয়মিত ব্যয় হয়েছে।
এই দু’টি অডিট আপত্তিতে ডিএসসিসি’র দ্রব্য সামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের অপারগতাপত্র পাওয়া যায়নি।
এ দু’টি আপত্তির জবাবে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নিরাপত্তা মুদ্রণালয় মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরে মালামাল ক্রয় করার লক্ষ্যে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু প্রকাশনা অধিদফতর থেকে অপারগতা প্রকাশ করায় ডিএসসিসির ভাণ্ডার ও ক্রয় বিভাগ পাবলিক প্রকিউমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ী উন্মুক্ত ইজিপি দরপত্রের মাধ্যমে এসব দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় করে। সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ওই অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি করার জন্যও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়।
অথচ অডিট আপত্তির জবাবের সঙ্গে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরের বাংলাদেশ নিরাপত্তা মুদ্রণালয় যে ‘অপারগতা’ সনদ সংযুক্ত করা হয়েছে তাতে সংস্থাটি জানিয়েছে- ‘সিটি করপোরেশনের চাহিদাকৃত ৩ লাখ ৮১ হাজার নবায়নযোগ্য ট্রেড লাইসেন্স মুদ্রণ করতে ১৮/২৩ সাইজের ৮২২ রিম ৪৮০ শিট সিকিউরিটি পেপার এবং কভারের জন্য ২২/২৮ সাইজের ৩৯৬ রিম রিয়েল আর্ট কার্ড এর প্রয়োজন হবে। বর্তমানে এ প্রেসে ওই কাগজ পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুদ না থাকায় তা মুদ্রণ-সরবরাহের লক্ষ্যে প্রাক্কলন প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় ডিএসসিসি হতে ওই সিকিউরিটি পেপার এবং রিয়েল আর্ট কার্ড সরবরাহ করা হলে তা দ্বারা চাহিদাকৃত নবায়নযোগ্য ট্রেড লাইসেন্স বই মুদ্রণ করে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এ পরিমাণ পেপার সরবরাহ করার সম্মতি জ্ঞাপন করলে চাহিদাকৃত নবায়নযোগ্য ট্রেড লাইসেন্স বই মুদ্রণের লক্ষ্যে প্রাক্কলন প্রস্তুত করে প্রেরণ করা যেতে পারে।’ কিন্তু সিটি করপোরেশন সে পেপার সরবরাহ না করে এর বদলে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান থেকে ঠিকাদার দিয়ে মালামাল ক্রয় ও ছাপার কাজ সম্পন্ন করেছে।
দু’টি আপত্তির মধ্যে স্টেশনারির মালামাল ক্রয়ের আপত্তিটিতেও ডিএসসিসির পক্ষ থেকে একই জবাব দেওয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ নিরাপত্তা মুদ্রণালয় মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতর কোনও স্টেশনারি পণ্য উৎপাদন করে না। আর ডিএসসিসির পক্ষ থেকে কোনও স্টেশনারি পণ্য সরবরাহের বিষয়ে প্রকাশনা অধিদফতরকে দেওয়া পত্রের মধ্যেও বিষয়টির উল্লেখ নেই।
জানা গেছে, এই ক্রয়ের সঙ্গে সংস্থার বর্তমান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা (পরিদর্শনও মান নিয়ন্ত্রণ) মো. লিয়াকত হোসেন জড়িত। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই আমরা প্রতিটি ক্রয় টেন্ডারের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছি। সিটি করপোরেশন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের আয় নিজস্ব তহবিলের। এখানে সরকারের কোনও অর্থ নেই। আমরা এটা অডিট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া বাংলাদেশ নিরাপত্তা মুদ্রণালয় আমাদেরকে একটা অপারগতা পত্র দিয়েছে। সে জন্যই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মালামাল ক্রয় করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান অডিট ও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মো. খাদেমুল করিম ইকবাল বিষয়টি স্বীকার করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,প্রকৃত অর্থে এটাকে অবশ্যই অনিয়ম বলতে হবে। কারণ, সিটি করপোরেশনও সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান। এর ক্রয় সরকারি নিয়মেই হতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে যখন মালামাল সরবরাহকারী সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান অপারগতা প্রকাশ করে তখন আমাদের আর কিছুই করার থাকে না।
বাংলা ট্রিবিউন