নিজস্ব প্রতিবেদক:
মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের কথা বিবেচনা করে রাজশাহীতে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে কেটে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ। তবে ইলিশ যেন সোনার হরিণই থেকে গেছে নিম্নবিত্তদের কাছে। কারণ ২৫০ গ্রামের নিচে কেটেও বিক্রি করা হচ্ছে না ইলিশ। আর ওই পরিমাণ ইলিশ কিনতেও গুনতে হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকা। ফলে নিম্নবিত্তদের নাগালের বাইরেই থেকে যাচ্ছে ইলিশ। এতে করে অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকজন কেটে বিক্রি হওয়ার খবরে নগরীর নিউমার্কেট এলাকার ইলিশ বাজার ও সাহেব বাজার মাছ বাজারে ঢু মারলেও শেষে কালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে তাঁদের। যদিও বছর কয়েক আগেও বড় আকারের ইলিশ বাজারে কেটে বিক্রি হতো। তবে বছর দশেক ধরে সেটি বন্ধ হয়ে যায় দাম বেড়ে যাওয়ায়। তার পর থেকে গরিবের পাতে উঠে না ইলিশ।
রাজশাহীর ইলিশ ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্তত বছর পনেরো আগ থেকেই নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষরা ইলিশ খেতে ভুলে গেছেন। তবে কালে-ভদ্রে মধ্যবিত্তের পাতে উঠতো ইলিশ। সেটিও বছর চারেক আগ থেকে যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ এক সময় ভরা বর্ষায় ইলিশ বাঙ্গালী ধনি-গরিব সবার পাতেই চড়ত বলে। সেখানে বাদ যায়নি রাজশাহীর মানুষও। কিন্ত সেই ইলিশ মাছ এখন কেবল বড়লোকদের তরকারিতে পরিণত হয়েছে। রাজশাহীর বাজারে গতকাল বৃহস্পতিবার এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকা, দেড় কেজি থেকে পৌনে দুই কেজি ওজনেরগুলো ২২-২৫শ’ টাকা, ৩০০-৩৫০ গ্রামেরগুলো ৮-৯শ’ টাকা আর ৫-৬শ’ গ্রামেরগুলো এক হাজার থেকে ১৪শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
বছরের শুরুর দিকে যদিও দাম এখনকার চেয়ে কিছুটা কম ছিল। তবে পূঁজার কারণে দাম অনেক বেড়েছে বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। ফলে বাজারে ইলিশের বেচা-কেনাও তেমন নাই। যে অল্পকিছু খদ্দের আসছেন, সেগুলোর অন্তত ৯৫ ভাগই উচ্চবিত্ত শ্রেণির। বাকি মধ্যবিত্ত শ্রেণির যারা আসছেন, তারা ছোট সাইজের দুই-একটা ইলিশ কিনছেন। বা দাম জেনে চলে যাচ্ছেন। আর নিম্নবিত্তরা তো গোটা ইলিশ কেনার কথা এখন স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না।
এমন পরিস্থিতিতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের কথা বিবেচনা করে বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টা থেকে নগরীর সাহেববাজার মাছবাজারে রাজশাহী মৎস্যজীবী সমিতির আয়োজনে কেটে ইলিশ বিক্রির উদ্বোধন করেন রাজশাহী ব্যবসায়ী সমন্বয় পরিষদ।
পরিষদের সভাপতি ফরিদ মামুদ হাসান ও সাধারণ সম্পাদক সেকেন্দার আলী কেটে মাছ বিক্রির উদ্বোধন করেন। তবে ২৫০ গ্রামের নিচে ইলিশ বিক্রি করছেন না ক্রেতারা। আর সেই ২৫০ গ্রাম ইলিশ কিনতেও ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকা। ৬-৭ গ্রামের ওজনের ইলিশগুলো কেটে ২৫০ গ্রাম বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা দরে। অথচ এই আকারের ইলিশ গোটা বিক্রি হচ্ছে ১৬-১৮শ টাকা দরে। আবার ৪-৫শ গ্রাম আকারের ইলিশ কেটে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা দরে। কিন্তু গোটা বিক্রি হচ্ছে ১২-১৪শ টাকা দরে। ফলে কেটে বিক্রি করতে গিয়েই ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা লাভের কৌশল হাতে নিয়েছেন। এতে করে নিম্নবিত্তরা হতাশ হয়েই বাড়ি ফিরে আসছেন।
রাজশাহী নগরীর নিউ মার্কেট ইলিশের আড়তের খুচরা ইলিশ বিক্রি করেন আলাউদ্দিন। প্রায় ৩০ বছর ধরে সেখানে ইলিশ বিক্রি করে সংসার চালান তিনি। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, এখুন ভরা মৌসুম। তারপরেও বাজারে ইলিশ তেমন অ্যাসছে না। গত দুই তিন বছরের মতো এবারও দাম শুরু থেকেই চড়া। বাজারে যারা ইলিশ কিনতে অ্যাসছেন, তারা অধিকাংশই বড় লোক মানুষ। তারাই সাধারণত ইলিশ কেনেন। সারাদিন বসে থেকে যদি ৫০ জন খরিদ্দার আসে, তাহলে বড়ো জোর ২-৩ জন আসেন মধ্যবিত্ত। তাদের মধ্যে দাম-দর করে কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন। আর কেউ কেউ ছোট সাইজের ইলিশ দুই-একটা কিনছেন। তবে কাটি বিক্রি করলেও নিম্নবিত্তরা দাম বেশি থাকায় ইলিশ কিনতে প্যারছেনা না।’
তিনি আরও বলেন, এক সময় ভরা বর্ষায় দুই কেজি আড়াই কেজি ওজনের ইলিশ অনেক পাওয়া যেত। এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। ১৫-২০ বছর আগেও বর্ষার সময় গরিব মানুষও ইলিশ খ্যাতে পারতেন। কারণ তখন দাম কমে যাত। এখন তো সবসময় ইলিশের দাম চড়া। গরিব বা মধ্যবিত্ত মানুষরা ইলিশ কিনবে কি করে?’
আরেক ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন বলেন, ‘এক কেজি বা তার ওপরে হলেই ইলিশের দাম প্রায় দ্বিগুন হযে যায়। ১০-১৫ বছর আগেও আমরা কেটে ইলিশ বিক্রি করেছি। তখন গরিব মানুষও এক পোয়া ইলিশ কিনতে আসতেন। এখুন কেটে বিক্রি হলেও গরিব মানুষরা ইলিশ কিনতে পারছেন না।
এ বাজারে ইলিশ কিনতে আসা আসলাম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘গত প্রায় এক মাস ধরে ভ্যাবছি ইলিশ কিনব। কিন্তু দাম তো কইমছে না। বরং বেড়েই চলেছে। তাই কিনতে আশার সাহস পাইনি। আজ শুনলাম কেটে বিক্রি হচ্ছে। এসেও দেখি গোটার চেয়ে কাটা ইলিশের দাম কেজিতে অন্তত দুইশ টাকা বেশি। এক পোয়া ইলিশ ৪০০-৫০০ টাকার নিচে নাই। সারাদিনেও তো এতো টাকা আয় হয় না আমার। তাহলে কিনব কি করে? তাই খালি হাতে বাড়ি যাচ্ছি।’
আরেক ক্রেতা পরিমল কুমার বলেন। ‘বাড়ির সবারই পছন্দ ইলিশ। কিন্তু এবারও দাম চড়া। পুঁজার উৎসবে একটা ইলিশ না হলে কেমন হয়, তাই দাম যায় লাগুগ এক কেজির কিছু ওপরের একটা ইলিশ নিছি। এবছর আর কিনব না।’
রাজশাহীর ইতিহাস গবেষক মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘১৫-২০ বছর আগেও বর্ষায় ধনি-গরিব প্রায় সবার পাতেই উঠতো ইলিশ। এখন গরিবেরা আর ইলিশ কিনতে পারে বলে মনে হয় না। ইলিশ এখন বড়লোকদের খাবার। মধ্যবিত্তরাও তেমন কিনতে পারেন না।’ তিনি বলেন, এক সময় রাজশাহীর পদ্মা নদীতেও বর্ষায় ইলিশ ধরা পড়তো। দেশের ইলিশ প্রধান অঞ্চলের চেয়ে পরিমাণে কম হলেও এখন রাজশাহীর পদ্মায় সেটিও হারিয়ে গেছে। মাঝে-মাঝে দুই-একটা জাটকা জেলেদের জালে ধরা পড়ে বলে শুনি।’