শনিবার , ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৫শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

এবার ইসরায়েলেই নেতানিয়াহুবিরোধী বিক্ষোভ

Paris
সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৪ ৯:২২ পূর্বাহ্ণ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি স্যামুয়েল জুভোগার বলেছেন, গাজা নিয়ে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে ব্যর্থ হলে পরিষদের পক্ষ থেকে নতুন করে ভাবতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর আগে কয়েক দফায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গত ২৬ মার্চ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস হওয়ার পর মিসর ও কাতারের সহায়তায় যখন ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা নিয়ে আলোচনা চলছে এবং সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের চাপ রয়েছে একটি যুদ্ধবিরতির দিকে যাওয়ার, এমন পরিস্থিতিতেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজায় নতুন করে সেনা সমাবেশের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে তিনি কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করে গাজায় অভিযান অব্যাহত রাখবেন। এই সেনা সমাবেশের ঘটনা ঘটার আগে সেখান থেকে ছয়জন ইসরায়েলির মৃতদেহ উদ্ধারের পর গোটা ইসরায়েলে নেতানিয়াহুবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। দাবি উঠেছে হামাসের হাতে বন্দি বাকি জিম্মিদের জীবিত উদ্ধারের স্বার্থে তাদের সঙ্গে দ্রæত একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকরের।

হামাসের পক্ষ থেকেও বন্দি মুক্তির শর্ত হিসেবে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের কথা বলা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যে এখনো শতাধিক জিম্মি রয়েছে হামাসের হাতে। সময় যতই অতিবাহিত হবে, তাদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা ততই ফিকে হয়ে যাবে। নেতানিয়াহু স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন কোনো অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তর্জাতিক চাপের কাছে তিনি নতি স্বীকার করবেন না।

বলা যায়, ইসরায়েলের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। দেশটি সৃষ্টির পর থেকে এই ৭৪ বছর সময়ের মধ্যে মোট চার দফায় এ পর্যন্ত ১৭ বছর দেশ শাসন করেছেন তিনি। মধ্যপ্রাচ্য তথা অঞ্চলটিতে ইসরায়েলের স্বার্থ নিয়ে তাঁর চেয়ে কেউ বেশি জ্ঞান যেমন রাখেন না, তেমনি সব কিছুকেই তিনি তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যও যথেষ্টভাবে ব্যবহার করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন। সর্বশেষ ২০২২ সালে নির্বাচিত হয়ে তিনি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে জোট বেঁধেছেন এমন কয়েকটি ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে চায় এবং হামাসের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান বেশ কঠোর।

এমন অবস্থায় তিনি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে এর বাইরে দেশের বিচারব্যবস্থায় সংস্কার আনয়নের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে আরো পোক্ত করতে চেয়েছেন। এর আগের বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নানা রকম দুর্নীতির কারণে তাঁর বিরুদ্ধে বিচারিক ব্যবস্থা গ্রহণ যখন চলমান ছিল, এমন অবস্থায় শরিকদের নিয়ে আবারও ক্ষমতার দৃশ্যপটে প্রত্যাবর্তন করে বিচারব্যবস্থায় সংস্কার এনে সেখানে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস নেন। এর বিরুদ্ধে তিনি জনগণের পক্ষ থেকে প্রথম ক্ষোভ এবং বিক্ষোভের সম্মুখীন হন। এর রেশ কাটতে না কাটতেই গত বছর ৭ অক্টোবর হামাসের অভিযান এবং বলা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে আগে থেকেই ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যর্থতার ফলে এই হামলায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি নতুন করে চাপে ফেলে নেতানিয়াহু সরকারকে।

১১ মাস ধরে গাজায় ব্যাপক হামলা, বোমাবর্ষণ, বেসামরিক জনগণ এবং শরণার্থী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে লক্ষ্য করে হত্যাযজ্ঞ চালানো, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত থেকে এর বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন এবং সর্বশেষ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে হামলা বন্ধ করে যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে প্রস্তাব গ্রহণ—এসব কিছু নেতানিয়াহুকে ব্যাপক বিপর্যস্ত করে তোলে।

এবার ইসরায়েলেই নেতানিয়াহুবিরোধী বিক্ষোভপরিস্থিতি সামাল দিতে নেতানিয়াহুর সমর্থনে এগিয়ে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মাঝে ইসরায়েলের জন্য বরাদ্দ সামরিক সহায়তা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও পরবর্তী সময়ে তা আবার পুনর্বহাল করেন এবং সেই সঙ্গে একটি সম্মানজনকভাবে এই যুদ্ধ থেকে বের হয়ে যেতে কাতার ও মিসরের সহায়তায় যুদ্ধবিরতি আলোচনাটিতে কৌশলগতভাবে সমর্থন দেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এখানে বাইডেনের চাওয়া ছিল নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এখান থেকে বের হয়ে হামাসের হাতে বন্দি বাকি জিম্মিদের মুক্তির ব্যবস্থা করুন এবং অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলকে সহায়তার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ভাবম‚র্তির সংকট দেখা দিয়েছে, এই অবস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রও বের হয়ে আসুক। সব কিছুতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন নেতানিয়াহু। সার্বিক পরিস্থিতি বলছে, এই মুহ‚র্তে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতি কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরই চাওয়া নয়—খোদ ইসরায়েলের ভেতর থেকেই দীর্ঘ সময় ধরে এই দাবি করা হয়ে আসছে। আমাদের এটিও মনে থাকার কথা যে এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ইসরায়েলের বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে ক্ষোভ দেখিয়েছিল নিজ দেশের মানুষই। তারা এ ধরনের হামলা সম্পর্কে আগে থেকে কোনো ধারণা না পাওয়াকে নেতানিয়াহু সরকারের চরম ব্যর্থতা হিসেবে বলে আসছিল। এই হামলার পাল্টা হামলা হিসেবে গাজায় ব্যাপক পরিসরে হামলা পরিচালনাকেও ইসরায়েলের সাধারণ মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য শঙ্কা হিসেবে দেখছিল। বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল। নেতানিয়াহু সব কিছুকেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন নিজের এবং তাঁর সরকারের কিছু ডানপন্থী শরিকের মুষ্টিমেয় স্বার্থ হাসিলের প্রয়োজনে।

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরায়েলের ক‚টনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে একজন পরীক্ষিত নেতা। এর আগেও তিনি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল প্রশ্নে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি ইসরায়েলের মানুষের মনে তাদের জাতীয়তাবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সবচেয়ে বড় পছন্দের ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভ‚ত হয়েছিলেন। ব্যক্তিগতভাবেও তিনি সব সময় ফিলিস্তিনিদের দাবিয়ে রাখা এবং গাজা ও পশ্চিম তীরে স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করে আসছিলেন। এই সব কিছুকে অতিক্রম করে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন অনেক বিতর্কে। একই সময়ে নিজের নেতৃত্বকে কুক্ষিগত করতে গিয়ে নিজ দল এবং দেশের ভেতর তাঁর বিকল্প নেতৃত্ব উঠে আসার ক্ষেত্রেও নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করেছেন। এমন অবস্থায় এসে ইসরায়েলের জনগণ এমন কোনো বিকল্প দেখছে না, যার মধ্য দিয়ে নেতানিয়াহু সরকারের পরিবর্তে এর চেয়ে ভালো কোনো শাসনব্যবস্থা অর্জন করতে পারে। তার পরও সাম্প্রতিক সময়ে যে অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের মানুষের মনেও এই বোধের উদ্রেক ঘটেছে যে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের নিরাপত্তার নামে তারা বিশ্বের কাছে ক্রমেই ঘৃণিত জাতিতে পরিণত হচ্ছে। একটি যুদ্ধবিরতির দ্বারপ্রান্তে এসেও যদি সেটি কার্যকর না হয়, তাহলে ধরেই নিতে হবে যে এর জন্য দায়ী কেবল নেতানিয়াহুর একগুঁয়েমিই নয়, তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থের বিষয়, যার মাধ্যমে তিনি জোর করে একটি চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দিনশেষে জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে রয়েছেন। এখানেই সবচেয়ে বড় ভুলটি করছেন তিনি।

এদিকে আরেকটি যে ভুল নেতানিয়াহু করে বসেছেন, তা হচ্ছে পশ্চিম তীরে জেনিনের শরণার্থী শিবিরে হামলা চালানো হয়েছে, যা তাঁর ভাষায় ভবিষ্যৎ হামলা প্রতিহত করার একটি পদক্ষেপ। এরই মধ্যে সেখানে বহুসংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছে। ফিলিস্তিনের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক একজন প্রতিবেদক এই মর্মে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে গাজার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে পশ্চিম তীরে, আর এর মধ্য দিয়ে গোটা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসনের ব্যাপকতা লাভ করতে পারে। এটিকে ভবিষ্যতের জন্য আশনিসংকেত হিসেবে বর্ণনা করে তিনি এর লাগাম টেনে ধরতে বলেছেন। তিনি এটিও যুক্ত করেছেন যে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করার অনেক প্রমাণ তাঁদের হাতে রয়েছে।

সব শেষে আমরা এটিই ধরে নিতে পারি যে হামাস, হিজবুল্লাহ, ইরান এবং অতঃপর নিজ দেশের ভেতর থেকে প্রবল বিরোধিতা মোকাবেলা করে নিজ ক্ষমতা ধরে রাখা নেতানিয়াহুর জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই মুহ‚র্তে নেতানিয়াহুর বিষয়ে অনেকটাই বিরক্তি প্রকাশ করছে। তাদের পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতি তাদের সমর্থনের উদ্দেশ্য অনেকটাই ম্লান হতে বসেছে ব্যক্তি নেতানিয়াহুর কারণে। সব কিছু মিলিয়ে নেতানিয়াহুর ভাগ্য এখনো বহাল আছে সরকারে তাঁর শরিক কয়েকটি দল এবং এদের কয়েকজন ব্যক্তির কারণে, যা যেকোনো সময় টলোমলো হয়ে উঠতে পারে। তবে একটি যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে নেতানিয়াহুই সবচেয়ে বড় বাধা—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

সূত্র: কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ - মতামত