মঙ্গলবার , ৪ জুন ২০২৪ | ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একটি ট্রেন চালাতে এবার পৌনে দুই হাজার কোটি টাকা খরচ রেলের

Paris
জুন ৪, ২০২৪ ১:৪৯ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক :
একটি মাত্র ট্রেন চালাতে নতুন করে রেললাইন ও স্টেশন নির্মাণের পেছনে প্রায় পৌনে দুই হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে। ঈশ্বরদী-ঢালারচর ৭৮ কিলোমিটারের এই রেলপথটি দিনে শুধুমাত্র একটি ট্রেন চলাচল করে। সকালে ঢালারচর থেকে একবার রাজশাহীতে আসে।

আর বিকেলে রাজশাহী থেকে ঢালার চরে যায়। বলা যায় দিনে দুই বার যাতায়াত করে একটি ট্রেন। ফলে দিনের বাকিটা সময় পড়ে থাকে। পাশাপাশি এই রেলরুটের জন্য নির্মাণ করা ১০টি স্টেশনও পড়ে আছে অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায়। তবে ভবিশ্যতে আরও একাধিক ট্রেন চালানোর লক্ষ্য নিয়ে এ লাইন এবং ১০টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

তাদের দাবি, চাহিদা আছে। কিন্তু ট্রেন সঙ্কটের কারণে একটির বেশি ট্রেন দেওয়া যাচ্ছে না এ লাইনে। ফলে পৌনে দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে এখন একটি ট্রেনই চালাতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সূত্র মতে, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন লাইন নির্মাণ’ শীর্ষক এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে মোট ১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকার বেশি। ব্যয়ের শতভাগ অর্থই সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেছিলেন। এর পর প্রথম ধাপে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঈশ্বরদী-পাবনা ৩০ কিলোমিটার রেলপথের কাজ শেষ হয়।

ওই বছরের ১৪ জুন এই ৩০ কিলোমিটারে রাজশাহী-পাবনা রুটের ‘পাবনা এক্সপ্রেস’ নামে একটি ট্রেন চালু করা হয়। এর পর পুরো কাজ শেষে ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি রেলপথটি চালু করা হয়। তখন ‘পাবনা এক্সপ্রেস’ ট্রেনের নাম পরিবর্তন করে ‘ঢালারচর এক্সপ্রেস’ রাখা হয়। সেই থেকে রেলপথটিতে শুধুমাত্র রাজশাহী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত একটি ট্রেনই চলে। করোনাকালে ট্রেনটি ছয়মাসের জন্য বন্ধ হয়েছিল। তখন লাইনটি একেবারে পড়েছিল। এখন এই ট্রেনটি সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে ঢালারচর থেকে ছেড়ে বেলা ১১টায় রাজশাহী পৌঁছায়। একই ট্রেন বিকাল সাড়ে ৪টায় রাজশাহী থেকে ছেড়ে রাত ৮টা ১৫ মিনিটে ঢালারচর পৌঁছায়। এভাবে দিনে দুই বার এবং সপ্তাহে ছয়দিন এ লাইন দিয়ে চলে ট্রেন।

রেলওয়ে সূত্র মতে, পাবনা থেকে ঢালারচর পর্যন্ত রেল লাইনটি চালু করতে নতুন ১০টি স্টেশনও নির্মাণ করা হয়। এছাড়াও লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করতে হয়েছে ৬০টি। সঙ্গে ছোট-বড় ৯১টি সেতুও নির্মাণ করতে হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে ওই সময়। প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব অনিয়মের চিত্র। পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষাতেও অনিয়ম ধরা পড়ে। সেস অডিট আপত্তি এখনও নিষ্পত্তি করতে পারেননি দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা।

স্থানীয় নাদের আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘দিনে মাত্র একটা ট্রেন চলে এই পথে। স্টেশনগুলো প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এসব দেখভাল করার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রহরীও নেই। কোন কোন স্টেশন একেবারে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। তিনি আরও বলেন, রেললাইনটি নির্মাণের কারণে পাবনার ৯টি উপজেলার মধ্যে শুধু ঈশ্বরদী, চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়ার অল্প কিছু মানুষ সুবিধা পাচ্ছে। তবে নতুন রেললাইনে পাবনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত ট্রেন দেওয়া হলে পুরো জেলা সুবিধা পাবে। তাই দ্রুতই ঢাকা-পাবনা ট্রেন দেওয়া দরকার।

পাবনার সাদুল্লাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম মোল্লা রোববার বলেন, ‘এখন এই লাইনের খুব বেশি উপকার হচ্ছে না। শুধু পাবনার তিনটি উপজেলার মানুষ একটি ট্রেনে রাজশাহী যাওয়া-আসা করছেন।

স্থানীয়রা জানান, পাবনা-ঢালারচর রেলরুটের ১০টি স্টেশনের মধ্যে বাঁধের হাট, কাশিনাথপুর, সাঁথিয়া, রাজাপুর, তাঁতিবন্ধ, দুবলিয়া ও রাঘবপুর স্টেশনে রেলওয়ের নিজস্ব কোন লোকবল নেই। চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী জনবল দিয়ে স্টেশনগুলো চালানো হয়। এসব স্টেশনে নিরাপত্তাকর্মীও থাকে না। ফলে স্টেশনে থাকে বখাটেদের উৎপাত। বসে মাদকের আড্ডা।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, এই রেলপথটি দিয়ে একটি ট্রেনে এখন মাসে গড়ে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার জন যাত্রী পরিবহন করা হয়। সবশেষ গত মার্চ মাসের হিসাব অনুযায়ী ঢালারচর এক্সপ্রেস ৪৭ হাজার ৬৯৫ জন যাত্রী পরিবহন করেছে। তাদের কাছে ৩৫ লাখ ৭ হাজার ৬২ টাকার টিকিট বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু ট্রেনটির পরিচালনাসহ স্টেশন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেছনে ব্যয় এর চেয়েও কয়েক গুন বেশি হচ্ছে। বিপুল টাকা লোকসান করে রেলপথটিতে মাত্র একটি ট্রেন চালানোর সমালোচনা করেছেন

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিয়নাল প্ল্যানিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান রিপন বলেন, ‘এই ধরনের প্রকল্প আসলেই একটা দুর্ভাগ্যজনক। প্রত্যেকটা প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে এর কস্ট ইফেক্টিভ এনালাইসিস করা দরকার। কত খরচ করলে রিটার্ন কত আসবে, সেটা হিসাব করতে হবে। রিটার্ন আনার পরিকল্পনা থাকতে হবে।’

জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ‘এই রেলপথে আরও ট্রেনের দরকার আছে। কয়টা দরকার সেটা আমরা এখনও হিসেব করে দেখিনি। কারণ, আমাদের সামর্থ্যই নেই এখন নতুন ট্রেন চালানোর মতো। ট্রেন সঙ্কটের কারণে একটা ট্রেন চালানোর সামর্থ্য আছে, সেটাই দিয়েছি।’ এই রেলপথে পাবনা-ঢাকা ট্রেন চালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা মহামান্য রাষ্ট্রপতিও চেয়েছিলেন। কিছুদিন এটা নিয়ে আলোচনা হয়ে থেমে গেছে। এখন কোন আলোচনা নেই।

সর্বশেষ - ভ্রমণ