নিজস্ব প্রতিবেদক:
আইন ভেঙে নাবিল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ছয় হাজার ৩৭০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বেসরকারি খাতের তিন ব্যাংক। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড চার হাজার ৫০ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এক হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এক হাজার ১২০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একক গ্রাহকের ঋণসীমা লঙ্ঘন করে মাত্র চার মাসের মধ্যে এসব ঋণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত জামানত ও ডকুমেন্টও রাখা হয়নি। ঋণের অর্থ কোথায় ব্যবহার হবে তাও পরিষ্কার নয়। তবে গ্রুপটির দাবি সব নিয়ম অনুসরণ করেই ঋণ পেয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সন্দেহ, ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বেনামি হিসেবে এসব ঋণ নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যে ব্যাংক তিনটি আগ্রাসীভাবে নাবিল গ্রুপকে ঋণ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, কোনো ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ কোনো কোম্পানি বা গ্রুপকে দিতে পারবে না। সাধারণভাবে কোনো অবস্থাতেই ফান্ডেড ঋণের পরিমাণ ১৫ শতাংশের বেশি হবে না। ফান্ডেড ঋণ বলতে ব্যাংক থেকে সরাসরি টাকা দেওয়াকে বোঝায়। আর নন-ফান্ডেড বলতে এলসি, গ্যারান্টিসহ বিভিন্ন দায়কে বোঝানো হয়। কিন্তু নাবিল গ্রুপকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব নিয়ম মানা হয়নি।
গত জুন শেষে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মোট মূলধনের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকা। এর ২৫ শতাংশ হিসেবে ব্যাংকটি একটি গ্রুপকে সর্বোচ্চ দিতে পারবে ২ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। কিন্তু নাবিল গ্রুপকে দিয়েছে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি। একই সময়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ছিল তিন হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটি নাবিল গ্রুপকে সর্বোচ্চ ঋণ দিতে পারবে ৯৩০ কোটি টাকার মতো। কিন্তু দিয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে জুন শেষে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ছিল তিন হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটি গ্রুপটিকে ঋণ দিতে পারে সর্বোচ্চ ৮১৪ কোটি টাকা। কিন্তু দিয়েছে এক হাজার ১২০ কোটি টাকা। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে নাবিল গ্রুপ একেবারে নতুন। তার পরও তাদের বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের বড় ব্যবসা পরিচালনার দক্ষতা এবং অর্থের সঠিক ব্যবহার হয়েছে কিনা তা যাচাই করা দরকার।
যোগাযোগ করা হলে নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘সব নিয়ম মেনেই ঋণগুলো নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর করা অডিট রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই ঋণ দিয়েছে। কোথাও কোনো ঘাটতি নেই। ঘাটতি থাকলে নিশ্চয়ই ব্যাংকগুলো আমাদের ঋণ দিত না।’ এ ছাড়া নাবিল গ্রুপ সুনামের সঙ্গে ২০ বছর ধরে ব্যবসা করছে বলেও দাবি করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ বলছে, গত ২১ মার্চ ইসলামী ব্যাংকের বোর্ডসভায় ব্যাংকটির রাজশাহী শাখার গ্রাহক নাবিল ফিড মিলস ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়। একই ব্যাংকের গুলশান শাখার গ্রাহক নাবিল গ্রেইন ক্রোপসের নামে অনুমোদন দেওয়া হয় ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ। চলতি বছরের ২৩ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বোর্ডসভায় নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নাবিল ফিড মিলস এবং শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। একই বছরের ৩০ মে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বোর্ডসভায় গুলশান শাখা থেকে নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নাবিল ফিড মিলস এবং শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে এক হাজার ১২০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে তিন ব্যাংকের কাছে এ গ্রুপটির ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে নাবিল গ্রুপের নেওয়া ঋণের মধ্যে ফান্ডেড (নগদ) ৪৫০ কোটি এবং নন-ফান্ডেড (এলসি ও ব্যাংক গ্যারান্টি) ৬৭০ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ সীমা নতুনভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই টাকা কি উদ্দেশে ব্যবহার হবে তার উল্লেখ নেই। এত বড় অঙ্কের ঋণের বিপরীতে কোনো জামানত নেওয়া হয়নি। কোন বিবেচনায় নতুন একজন গ্রাহককে এত বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হলো তা যাচাই করা জরুরি।
জানা যায়, নাবিল ফিড ও শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে যে শর্ত দেওয়া হয়েছিল, পরে তা শিথিল করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। যেমন প্রথমে প্রতি ত্রৈমাসিকে এলসি কমিশন দশমিক ৩০ শতাংশের শর্ত দেওয়া হলেও পরে তা শিথিল করে দশমিক ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত গ্যারান্টির ক্ষেত্রে সব পরিচালক এবং তাদের স্বামী/স্ত্রীর গ্যারান্টি ছিল। কিন্তু পরে শর্ত শিথিল করে শুধু পরিচালকদের গ্যারান্টি রাখা হয়। আমানত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল নিজ নামে অথবা রেফারেন্সে অন্যদের নামে প্রাথমিকভাবে ২০০ কোটি এবং পরে আমানত ৬০০ কোটি টাকায় উন্নীত করতে হবে। কিন্তু পরে তা শিথিল করে বলা হয়, পর্যাপ্ত আমানত রাখতে হবে। এ পর্যাপ্তের কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একটি নতুন ঋণের ক্ষেত্রে কোনো বিবেচনায় শর্ত শিথিল করা হলো তা জানা জরুরি। এ ছাড়া গ্রাহক বেনামে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান কিনা সেটিও যাচাই করতে হবে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের গুলশান শাখার নতুন গ্রাহক নাবিল গ্রেইন ক্রপসের অনুকূলে ৯৫০ কোটি টাকা নন-ফান্ডেড ঋণ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে এই ঋণে ২৩০ কোটি টাকা জামানত হওয়ার কথা। কিন্তু ঋণের শর্তে ১১০ কোটি টাকার আমানত অথবা লিয়েন থাকার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া নাবিল ফিড মিলসের নামে নতুন করে ৭০০ কোটি টাকাসহ মোট তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা। কিন্তু নাবিল গ্রেইন ক্রপস কোনো গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সন্দেহ এটিও গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। ফলে একক কোনো গ্রুপকে ঋণ দেওয়াসংক্রান্ত যে আইন রয়েছে, এটি তার লঙ্ঘন।
উল্লেখ্য, নাবিল গ্রুপের ওয়েবসাইটে গ্রুপটির ১৭ প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলোÑ নাবিল নব ফুড, ফাওয়ার মিল, ফিডমিল, অটোরাইস মিল, ডাল মিল, কনজুমার প্রোডাক্ট, নাবিল ফার্ম, ক্যাটল ফার্ম এবং নাবিল ট্রান্সপোর্ট উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এই ওয়েবসাইটে প্রোডাক্ট অপশনে মাত্র ৬টি পণ্যের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চাল, আটা, ময়দা, সুজি, ডাল ও পশুখাদ্য। কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মো. জাহান বক্স মণ্ডল, পরিচালক ইসরাত জাহান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম এবং উপপরিচালক মো. মামুনুর রশীদ।
এএইচ/এস